কালীবাবুর কথা শুনিয়া এই মোকদ্দমার অবস্থা আমরা অতি পরিষ্কাররূপে বুঝিতে পারিলাম। তখন আমরা কালীবাবু ও ত্রৈলোক্য উভয়কেই এই মোকদ্দমার আসামী করিলাম। পূর্বোক্ত সেই সকল টাকা ত্রৈলোক্য কালীবাবুর নিকট হইতে গ্রহণ করিয়া যে কোথায় রাখিয়াছে, তাহা জানিবার নিমিত্ত ত্রৈলোক্যকে লইয়া সবিশেষরূপে পীড়াপীড়ি করিলাম, তাহার ঘর বাড়ী খুড়িয়া উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিলাম; কিন্তু কোনরূপেই সেই টাকা বাহির করিতে পারিলাম না। কালীবাবুও সেই সম্বন্ধে আর কোন কথা বলিতে পারিল না, বা বলিল না।
মোকদ্দমা প্রথমতঃ মাজিস্ট্রেট সাহেবের নিকট প্রেরিত হইল। কেবলমাত্র কালীবাবুর কথা ব্যতীত ত্রৈলোক্যের বিপক্ষে আর কোনরূপ প্রমাণ সংগ্রহ করিতে পারিলাম না। কালীবাবু যে বাড়ী ভাড়া লইয়াছিল, তাহার অধিকারীকে যখন বলিলাম, আপনি আপনার এই ভাড়াটিয়া বাটীতে এই ত্রৈলোক্যকে কখনও আসিতে দেখিয়াছিলেন? তখন তিনি তাহার কিছুই বলিতে পারিলেন না। কেবলমাত্র ইহাই বলিলেন, আমার নিকট হইতে কালীবাবু আমার বাটীর চাবি লইয়া আসিলে, আমার বাটীতে কেহ আসিয়া বাস করিয়াছিল কি না, তাহা জানি না, বা দেখি নাই। জহরতের দোকানেরও কোন ব্যক্তিই রাণীজিকে দেখে নাই; সুতরাং কেহই ত্রৈলোক্যকে সেনাক্ত করিতে পারিল না। সহিস-কোচবান্ দোকানদার প্রভৃতিও কেহই ত্রৈলোক্যকে রাণীজি বলিয়া চিনিতে পারিল না। সুতরাং মাজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকট হইতে সে যাত্রা ত্রৈলোক্য নিষ্কৃতি লাভ করিল।
কালীবাবুর নিষ্কৃতির উপায় রহিল না। প্রথমতঃ কালী বাবু বাড়ীওয়ালার নিকট একমাসের বন্দোবস্তে বাটী ভাড়া লইয়া চাবিটা লইয়া আসিয়াছিল বটে; কিন্তু দুই তিনদিবসের মধ্যেই বাটীর প্রয়োজন হইল না বলিয়া, সেই চাবি প্রত্যর্পণ করিয়াছিল। সেই দুই তিনদিবসের মধ্যেই সেই বীভৎস-কাণ্ড সকলের অজ্ঞাত সারে কালীবাবু কর্তৃক সম্পাদিত হইয়াছিল, একথা ত দোষী নিজ মুখেই ব্যক্ত করিয়াছিল। অধিকন্তু বাড়ীওয়ালা, সহিস-কোচবান। প্রভৃতির সাক্ষ্যে ও সেনাক্তে তাহা একরূপ প্রমাণীকৃত হইল; চাক্ষুষ প্রমাণ না থাকিলেও, ঘটনা-পরম্পরায় অবিবোধী সমবায়ত্ব প্রমাণে কালীবাবু দোষ-মুক্ত হইতে সমর্থ হইল না। আড়গোড়ায় গিয়া যাহার নিকট গাড়ি ভাড়া করিয়া ভাড়ার টাকা জমা দিয়া ছিল, কালীবাবু তাহা কর্তৃকও পরিচিত হইল; সহিস-কোচবান্ ত চিনিয়াই ছিল। জহরতের দোকানের মালিক ও আমলাগণ কালীবাবুকে সবিশেষরূপেই চিনিয়াছিলেন; করেসি অফিসে তাঁহার নিকট হইতে নম্বরী-নোট বাইয়া কালীবাবু খুচরা নোট ও নগদ টাকা লইয়া রামজীলালের নাম ও ঠিকানা লিখিয়া দিয়া ছিল, তিনিও কালীবাবুকে ভাল করিয়া দেখিয়া বলিলেন যে, এই ব্যক্তিই রামজীলালের নাম ও ঠিকানা লিখিয়া আট হাজার টাকার নম্বরী-নোট ভাঙ্গাইয়া লইয়াছিল। এইরূপে বিধাতার চক্রে পড়িয়া আজ কালীবাবু আর উদ্ধার পাইল না।
যথাক্রমে কালীবাবুর মোকদ্দমা মাজিষ্ট্রেট সাহেব দায়রায় পাঠাইয়া দিলেন। সেই স্থানে জুরির বিচারে কালীবাবু হত্যাপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইল, এবং তাহার কাৰ্য্যের উপযুক্ত দণ্ডই প্রাপ্ত হইল। বিচারে তাহার ফাঁসির হুকুম হইল।
[সম্পূর্ণ]