রামজীলালের মৃতদেহ এইরূপে মৃত্তিকার ভিতর প্রােথিত করিয়া, ঘর সাজাইবার যে সকল দ্রব্য যে স্থান হইতে ভাড়া করিয়া আনা হইয়াছিল, সেই সকল দ্রব্য ভাড়া সমেত সেই স্থানে পাঠাইয়া দিলাম, এবং সেই বাড়ীর সদর দরজায় তালাবদ্ধ করিয়া একখানি ঠিকা গাড়ি আনিয়া আমরা সে দিবস সেই স্থান হইতে আপন বাসায় ফিরিয়া আসিলাম। বলা বহুল্য, যে সকল জহরত আমরা রামজীলালের নিকট হইতে গ্রহণ করিয়াছিলাম, তাহা আমাদিগের সঙ্গে আনিতে ভুলিলাম না।
পরদিবস অতি প্রত্যূষে আমি সেই জহরতগুলি এবং সেই বাড়ীর চাবি লইয়া বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া গেলাম। যাহার বাড়ী ভাড়া লইয়াছিলাম, তাহাকে যাহা বলিয়া চাবি ফিরাইয়া দিয়া আসিয়াছিলাম, তাহা আপনি পূৰ্বেই সেই বাড়ীওয়ালার নিকট হইতে অবগত হইয়াছেন। বাড়ীর চাবি ফিরাইয়া দিয়া সেই জহরতগুলি সেই পশ্চিমদেশীয় জমিদার মহাশয়ের নিকট লইয়া গেলাম। তিনি যেরূপ ভাবের জহরত আনিবার নিমিত্ত আমাকে ফরমাইস করিয়া ছিলেন, ঠিক সেই মত জহরত দেখিয়া অতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন। সমস্ত দ্রব্যই তাঁহার পসন্দ হইল। তিনি সেই সকল দ্রব্য গ্রহণ করিয়া তাহার দাম আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন। তাঁহার কথার উত্তরে আমি কহিলাম, এই সকল দ্রব্য দশ বার হাজার টাকার কম আমরা কাহারও নিকট বিক্রয় করি না; কিন্তু আপনার নিকট আমাদিগের অনেক দ্রব্য বিক্রয় হইবার আশা আছে, অথচ কোন্ দ্রব্যের কি মূল্য, তাহাও আপনি উত্তমরূপে বুঝিতে পারেন। এরূপ অবস্থায় এ সামান্য বিষয় লইয়া আমার আর কিছুই বলিবার আবশ্যক নাই। বিবেচনা করিয়া আপনি আমাকে যে মূল্য বলিয়া দিবেন, আমি সেই মূল্যেই উহা আপনাকে প্রদান করিব।
আমার কথা শুনিয়া জমিদার মহাশয় সেই জহরতগুলি আর একবার উত্তমরূপে দেখিলেন ও কহিলেন, আমার বিবেচনায় এই সকল দ্রব্যের মূল্য নয় হাজার টাকার অধিক বলিয়া অনু মান হয় না।
তাহার কথা শুনিয়া আমি কহিলাম, আপনি যে দাম বলিয়া ছেল, তাহা প্রায় ঠিকই হইয়াছে। এই সকল দ্রব্য আমার নয় হাজার টাকায় খরিদ। সেই মূল্যেও আমি উহা আপনাকে বিক্রয় করিতে পারি। ইহাতে আমার আর এক পয়সাও লাভ হয় না।
আমার কথা শুনিয়া জমিদার মহাশয় আর কোন কথা কহিলেন না। আমাকে এক হাজার টাকা পূর্বেই প্রদান করিয়া ছিলেন, এখন বক্ৰী আট হাজার টাকার নোট আনিয়া আমার হস্তে সেই দ্রব্যের মূল্য বলিয়া প্রদান করিলেন। তদ্ব্যতীত আমার লাভ ও পারিশ্রমিক বলিয়া আরও দুইশত টাকা আমাকে দিলেন।
তিনি আমাকে যাহা প্রদান করিলেন, তাহা নগদ টাকা নহে; নম্বরী-নোট। কতকগুলি হাজার টাকা করিয়া, ও কতক গুলি একশত টাকার হিসাবে। আমি সেই নোটগুলি গ্রহণ করিয়া সেই স্থান হইতে চলিয়া আসিলাম, এবং সমস্তই ত্রৈলোকের হস্তে প্রদান করিলাম। সে দিবস আর কোন স্থানে গমন করিতে বা অপর কোন কার্যে হস্তক্ষেপ করিতে ইচ্ছা হইল না। মনে কেমন একরূপ দুর্ভাবনা আসিয়া উপস্থিত হইল। এই সকল কথা যদি কোনরূপে প্রকাশ হইয়া পড়ে, তাহা হইলে আমাকে কি বলিতে হইবে, বা কোন উপায়ই বা অবলম্বন করিতে হইবে। এইরূপে নানা প্রকার পরামর্শ করিতে করিতে সেই রাত্রি অতিবাহিত করিলাম।
পরদিবস দিবা দশটার সময় সেই নোটগুলি সঙ্গে লইয়া, পুনরায় আমি আমার বাসা হইতে বহির্গত হইলাম, এবং করেনসি আফিসে গমন করিয়া সেই স্থানে সেই নোট গুলি প্রদান করিয়া, তাহার পরিবর্তে কতকগুলি দশ টাকার নোট ও কতক গুলি নগদ টাকা গ্রহণ করিলাম। নোটের পৃষ্ঠে নাম লিখিয়া দিতে বলায়, আমি রামজীলালের নাম ও বড়বাজারের ঠিকানা লিবিয়া দিলাম। বলা বাহুল্য, আমি আমার নাম ও ঠিকানা না দিয়া রামজীলালের নামেই সেই নোট ভাঙ্গাইয়া আনিয়াছিলাম। যাহা হউক, উক্ত সমস্ত টাকাই ত্রৈলোকের হস্তে প্রদান করিলাম।
আমি। ত্রৈলোক্য সেই সকল টাকা কোথায় রাখিয়াছে?
কালী। তাহা আমি বলিতে পারি না। সেই সকল টাকা একটা পিত্তলের কলসীর মধ্যে পুরিতে আমি দেখিয়াছি; কিন্তু পরিশেষে উহা যে কোথায় রাথিয়াছে, তাহা আমি বলিতে পারি না। কিন্তু আমি শুনিয়াছিলাম যে, ত্রৈলোক্য উহা কোন স্থানে মৃত্তিকার মধ্যে পুতিয়া রাখিয়াছে।
আমি। তাহার পর?
কালী। ইহার পর কয়েকদিবস পর্যন্ত আর কোনরূপ গোল যোগ শুনিতে পাইলাম না। তাহার পর পুলিসের লোক আসিয়া অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন। তাঁহাদিগকে আমি যাহা বলিয়া ছিলাম, তাহা আপনি পূৰ্বেই জানিতে পারিয়াছেন। যে সকল নোট আমি জমিদার মহাশয়ের নিকট হইতে পাইয়া, করেসি আফিস হইতে ভাঙ্গাইয়া আনিয়াছিলাম, সেই সকল নোট রামজীলাল লইয়া প্রস্থান করিয়াছে, এই কথাই কৰ্মচারী গণকে বলিয়াছিলাম। তাহাও করেনসি আফিসে অনুসন্ধান করিয়া আপনারা অবগত হইতে পারিয়াছিলেন যে, রামজীলালই সেই নোট ভাঙ্গাইয়া লইয়া গিয়াছে। ইহার পরই রামজীলালের নামে ওয়ারেন্ট বাহির হয়।
যে মাজিষ্ট্রেট সাহেব রামজীলালের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট বাহির করিবার আদেশ প্রদান করেন, তিনি কেবলমাত্র আমার সাক্ষ্য ও করেসি অফিসের একটী বাবুর সাক্ষ্য গ্রহণ করিয়াই সন্তুষ্ট হন, অপর কোন বিষয় অনুসন্ধান না করিয়াই ওয়ারেন্ট প্রদান করেন। তাহার পর আর যাহা ঘটিয়াছিল, তাহা আপনি স্বহস্তেই করিয়াছেন।