দোকানদারকে এইরূপ শিখাইয়া দিয়া তাহাকে সঙ্গে লইয়া আমি দোকানের বাহিরে আসিলাম, এবং সেই জুড়িগাড়ির নিকট দাঁড়াইয়া কহিলাম, এই গাড়িতে রাণীজি আছেন, তিনি অনেকগুলি জহরত ক্রয় করিবেন। আপনি এক একটী করিয়া জহরতের বাক্স তাহার হস্তে প্রদান করুন, ইহার মধ্যে যদি কোন দ্রব্য রাণীজির পসন্দ হয়, তাহা হইলে তাহার দর স্থির করিয়া দিয়া উহার মূল্য গ্রহণ করিবেন। আমার প্রস্তাবে দোকানদার সম্মত হইলেন, এবং এক একটী করিয়া নানা প্রকার জহরতের বাক্স রাণীজির হস্তে প্রদান করিতে লাগিলেন। সেই সকল জহরতের মধ্যে যে সকল জহরত রাণীজি পসন্দ করিলেন, বা যে সকল জহরত আমাদিগের লইয়া যাইবার পরামর্শ ছিল, সেই সকল জহরত ত্রৈলোক্য একটা একটা করিয়া আমার হস্তে প্রদান করিতে লাগিল। এইরূপে কতকগুলি জহরত আমার হস্তে প্রদান করিবার পর আমাদিগের পূর্ব পরামর্শ অনুযায়ী ত্রৈলোক্য আমাকে কহিল, আমি এখন বাসায় যাইতেছি। আপনি এই সকল জহরতের উপযুক্ত দাম দোকানদারের সহিত স্থির করিয়া আমার বাসায় লইয়া আসিবেন। আর হয় দোকানদারকে, না হয় তাহার দোকানের অপর কোন একজন লোককে সেই সঙ্গে লইয়া যাই বেন। আমার বাসায় গেলেই, আমি হয় ইহার নগদ মূল্য প্রদান করিব, না হয় কোন ব্যাঙ্কের উপর একখানি চেক প্রদান করিব। আমার বোধ হয়, এই সকল জহরতের মূল্য আট দশ হাজার টাকার অধিক হইবে না। সুতরাং এই সকল সামান্য দ্রব্যের মূল্য বাকী রাখিবার কোনরূপ প্রয়োজন দেখি না। আমাদিগকে কেবল এই মাত্র বলিবার পরই রাণীজি তাহার গাড়ি চালাইতে কহিলেন। দেখিতে দেখিতে সেই প্রকাণ্ড জুড়ি বড়বাজার অতিক্রম করিয়া চলিয়া গেল।
ত্রৈলোক্য গমন করিবার পর আমি সেই দোকানদারের সহিত একত্র বসিয়া যে সকল দ্রব্য ত্রৈলোক্য পসন্দ করিয়া গিয়াছিল, তাহার মূল্যের একটী তালিকা প্রস্তুত করিলাম। তালিকা প্রস্তুত হইলে, সেই জহরতগুলি লইয়া দোকানদারকে রাণীজির বাসায় গমন করিবার নিমিত্ত অনুরোধ করিলাম; কিন্তু তিনি নিজে না আসিয়া তাঁহার একজন অতিশয় বিশ্বাসী কর্ম্মচারী রামজীলালকে আমার সহিত পাঠাইয়া দিলেন। তিনি সেই সকল গহনার সহিত আমার গাড়িতে আসিয়া উপবেশন করিলেন।
ত্রৈলোক্য বড়বাজার হইতে প্রত্যাগমন করিলে প্রায় একঘণ্টা পরে আমি জহরতগুলির সহিত রামজীলালকে সঙ্গে করিয়া আমাদিগের সেই নূতন বাড়ীতে উপস্থিত হইলাম। সেই স্থানে উপস্থিত হইয়াই আমি আমার সেই গাড়ি বিদায় করিয়া দিলাম। ইতিপূর্বে ত্রৈলোক্যও প্রত্যাবর্তন করিবার পর তাহার জুড়ি বিদায় করিয়া দিয়াছিল।
রামজীলালকে সঙ্গে করিয়া আমি একবারে উপরে উঠিলাম। যে ঘরটী উত্তমরূপে সাজান ছিল, সেই গৃহে তাহাকে বসাইয়া তাহার সহিত দুই চারিটী কথা কহিতেছি, এরূপ সময় রাণীজি বা তৈলোক অন্য ঘর হইতে আসিয়া সেই গৃহে প্রবেশ করিল। আমি রামজীলালের সম্মুখে ত্রৈলোক্যকে কহিলাম, সমস্ত জহরতের দাম প্রায় দশ হাজার টাকা হইয়াছে। দোকানদার মহাশয় নিজে আসিতে পারেন নাই, তিনি তাঁহার এই বিশ্বাসী লোককে জহরতের সহিত আপনার নিকট পাঠাইয়া দিয়াছেন; কিন্তু ইহার মনিব ইহাকে বলিয়া দিয়াছেন যে, অগ্রে টাকা না পাইলে এই সকল জহরত যেন কাহারও হস্তে প্রদান করা না হয়। কারণ, কলিকাতা জুয়াচোরে পরিপূর্ণ।
আমার এই কথা শুনিয়া রাণীজি সেই স্থানে উপবেশন করিয়া রামজীলালের সহিত কথাবার্তা কহিতে লাগিল। সেই অব কাশে আমি একবার নিয়ে গমন করিয়া বাড়ীর ভিতর দিক হইতে সদর দরজা তালাবদ্ধ করিয়া দিয়া পুনরায় উপরে উঠিলাম। পরে যে স্থানে রামজীলাল বসিয়াছিলেন, তাহার এক পার্শ্বে গিয়া উপবেশন করিলাম।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।
আমি সেই স্থানে উপবেশন করিলে পর, ত্রৈলোক্য ওরফে বাণীজি, রামজীলালের নাম জিজ্ঞাসা করিল। উত্তরে রামজী লাল কহিল, রাণজি! আমার নাম রামজীলাল।
ত্রৈলোক্য। আমি যে সকল জহরত পসন্দ করিয়া দিয়া ছিলাম, তুমি সেই সকল জহরতই আনিয়াছ ত?
রামজীলাল। আমি তাহাই আনিয়াছি।
ত্রৈলোক্য। উহার দাম কত হইয়াছে?
রামজীলাল। প্রায় দশ হাজার টাকা।
ত্রৈলোক্য। তুমি কি কি দ্রব্য আনয়ন করিয়াছ দেখি? রামজীলাল। রাণীজি! আমাকে ক্ষমা করিবেন। আমার মনিবের আদেশ আছে যে, অগ্রে দাম না পাইলে এই সকল দ্রব্য কাহারও হস্তে প্রদান করিতে পারিব না।
ত্রৈলোক্য। এত সামান্য টাকার নিমিত্ত তোমার মনিবের এত অবিশ্বাস।
রামজীলাল। আপনাকে আমার কিছুমাত্র অবিশ্বাস নাই। আমার অপরাধ লইবেন না, আমাকে ক্ষমা করিবেন। আমি সামান্য চাকর হইয়া কিরূপে মনিবের আদেশ লঙ্ঘন করিব?
ত্রৈলোক্য। তোমার মনিবের এত অবিশ্বাস করিবার কারণ?
রামর্জীলাল। কয়েকবার জুয়াচোরের হস্তে পড়িয়া তিনি ঠকিয়াছেন, তাহাতেই আমাকে এইরূপ আদেশ প্রদান করিয়াছেন। আপনি ত সবিশেষ জানেন যে, কলিকাতা সহর জুমাচোরগণের দ্বারা পরিপূর্ণ।
আমি এতক্ষণ পর্যন্ত স্থির ভাবে সেই স্থানে বসিয়াছিলাম, রামজীলালের এই সকল কথা শুনিয়া আমি আর স্থির থাকিতে পারিলাম না। রাগের ভাব প্রকাশ করিয়া রামজীলালকে কহিলাম, তুমি জান না, কাহার সহিত কিরূপ ভাবে তুমি কথা কহিতেছ। তুমি জান, রাণীজি একটু রাগ করিলে তোমার মস্তক সহ এই বাটী হইতে প্রস্থান করা কঠিন হইবে?