উত্তরে আমি কহিলাম, বস্ত্রাদি আমি অতি অল্প পরিমাণেই বিক্রয় করিয়া থাকি। আমার অধিক কারবার জহরতের। কেন মহাশয় আপনি আমাকে একথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন?
জমিদার। আমার কিছু জহরতের প্রয়োজন হইয়াছে; সেই নিমিত্তই আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করিতেছি।
আমি তাহাকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলাম, আপনার কত টাকার জহরতের প্রয়োজন হইবে? তাহার উত্তরে তিনি কহি লেন, প্রায় দশ হাজার টাকার জহরতের প্রয়োজন।
আমি কহিলাম, এ অতি সামান্য কথা। আপনার কি কি দ্রব্যের প্রয়োজন, তাহার একটা তালিকা প্রস্তুত করিয়া আপনি আমাকে প্রদান করুন, আমি সেই তালিকা অনুযায়ী জহরত আনিয়া আপনাকে প্রদান করিব। আপনি সেই সকল জহরত প্রথমে যাচাই করিয়া দেখিবেন, এবং পরিশেষে তাহার মূল্য আমাকে প্রদান করিবেন।
আমার এই কথা শুনিয়া কি মূল্যের কি কি জহরতের প্রয়োজন, তাহার একটা তালিকা প্রস্তুত করিয়া জমিদার মহাশয় আমাকে প্রদান করিলেন। আমি সেই তালিকা গ্রহণ করিয়া তাঁহার একজন কর্ম্মচারীর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলাম। সেই কর্ম্মচারী সর্বদা জমিদার মহাশয়ের নিকট থাকিতেন, এবং তিনি যাহা বলিতেন, তাহা প্রায়ই তিনি শুনিতেন। আমি বলিতে ভুলিয়া গিয়াছি, জমিদার মহাশয়ের সহিত সাক্ষাৎ হইবার পূর্বেই আমি তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া, তাঁহার সহিত একরূপ বন্ধুত্ব স্থাপন করিয়াছিলাম। যে দিবস জমিদার মহাশয়ের নিকট কোন দ্রব্য বিক্রয় করিয়া কিছু অর্থ সংগ্রহ করিতে পারিতাম, সেই দিবস তাহা হইতে তাহাকেও কিছু অর্থ প্রদান করিতাম। সুতরাং জমিদার মহাশয়ের নিকট হইতে সৰ্ব্বদা যাহাতে আমি কিছু প্রাপ্ত হই, তিনি তাহাই করিতেন।
জমিদার মহাশয় আমাকে জহরতের ফরমাইস দিলে পরই, তিনি জমিদার মহাশয়কে কহিলেন, যে ব্যক্তি এত টাকার জহরত আপনার নিকট আনয়ন করিবেন, তাঁহাকে উহার নিমিত্ত কিছু অগ্রিম টাকা দেওয়া কর্ত্তব্য। কারণ, অগ্রিম কিছু টাকা প্রদান করিলে যতশীঘ্ন পারিবেন, জহরত লইয়া ইনি আপনার নিকট উপস্থিত হইবেন।
কর্ম্মচারীর কথা শুনিয়া জমিদার মহাশয় একখানি হাজার টাকার নোট বাহির করিয়া আমার হস্তে প্রদান করিলেন। বলা বাহুল্য, সেই স্থান হইতে আসিবার সময় আমি কর্ম্মচারীকে কিছু প্রদান করিয়া আসিলাম। সেই কৰ্ম্মচারীকে আমি মধ্যে মধ্যে কিছু কিছু প্রদান করিতাম বলিয়াই যে তিনি আমার উপর এতদুর অনুগ্ৰহ করিতেন, তাহা নহে। সময় সময় তাহাকে সঙ্গে করিয়া আমার বাসায় আনিতাম ও তাহাকে লইয়া আমি ও ত্রৈলোক্য নানারূপ আমোদ-আহলাদ করিতাম।
সেই টাকা লইয়া আমি সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম, এবং আপন বাসায় আসিয়া সেই টাকা ত্রৈলোক্যের হস্তে প্রদান করিলাম। এতগুলি টাকা আমি একবারে কোথায় পাইলাম, জিজ্ঞাসা করায়, আমি ত্রৈলোক্যকে আদ্যোপান্ত সমস্ত ব্যাপার বলিলাম। আমার কথা শুনিয়া ত্রৈলোক্য কহিল, তাহা হইলে সেই জমিদার মহাশয়ের নিকট আর গমন করিবার প্রয়োজন কি? এই হাজার টাকায় এখন অনেক দিবস আমাদিগের চলিবে।
ত্রৈলোক্যের কথার উত্তরে আমি কহিলাম, তাহা কি কখনও হইতে পারে। কারণ, জমিদার মহাশয়ের কর্ম্মচারী আমাদিগের বাসা পর্যন্ত অবগত আছেন। বিশেষতঃ যখন তাঁহারই কথায় বিশ্বাস করিয়া জমিদার মহাশয় আমাকে এই টাকা প্রদান করিয়াছেন, তখন তাহাদিগের নিকট আর গমন না করিলে, সেই কর্ম্মচারীই নিতান্ত বিপদগ্রস্ত হইবেন। সুতরাং তাঁহাকে অবমানিত করিয়া আমার সবিশেষ কোন ফল লাভ হইবে না। অধিকন্তু যদি তাহাদিগের সহিত প্রণয় রাখিয়া চলিতে পারি, তবে এক সহস্র কেন, এরূপ কত সহস্র টাকা আমি তাহাদিগের নিকট হইতে ক্ৰমে গ্রহণ করিতে সমর্থ হইব। তুমি যেরূপ প্রস্তাব করিতেছ, সেই প্রস্তাবে আমি কোনরূপেই সম্মত হইতে পারি না। কিন্তু আমি এক উপায় মনে মনে স্থির করিয়াছি। যাহা ভাবিতেছি, তাহা যদি কার্যে পরিণত করিতে পারি, তাহা হইলে আমাদিগের লাভও যথেষ্ট হইবে, এবং সেই কৰ্ম্ম চারী প্রভৃতি কাহার কোনরূপ অনিষ্ট হইবার সম্ভাবনা থাকিবে না। অথচ সেই জমিদার মহাশয়ের বাড়ীতে আমার খুব পসার থাকিবে।
এই বলিয়া আমি মনে মনে যাহা স্থির করিয়াছিলাম, তাহা ত্রৈলোক্যকে বলিলাম। আমার কথা শুনিয়া ত্রৈলোক্য প্রথমতঃ একবারে হতবুদ্ধি হইয়া সেই স্থানে বসিয়া পড়িল ও কহিল, এরূপ কাৰ্য আমার দ্বারা কখনই হইবে না। কিন্তু সে কি করিবে? আমার প্রস্তাবে পরিশেষে তাহাকে সম্মত হইয়া আমাকে সৰ্ব্বতোভাবে সাহায্য করিতে প্রস্তুত হইতে হইল।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ।
পরদিবস অতি প্রত্যূষে আমি আমার বাসা হইতে বহির্গত হইয়া গেলাম। সহরের ভিতর নানাস্থানে অনুসন্ধান করিয়া সুবিধা মত একটা বাড়ী দেখিতে পাইলাম। কোন গতিতে সেই বাড়ী ভাড়া করিতে পারিলে, আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিতে পারিব, এই ভাবিয়া খুঁজিয়া খুঁজিয়া সেই বাড়ীর মালিককে বাহির করিলাম। তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া কেবলমাত্র সাতদিবসের নিমিত্ত সেই বাড়ী ভাড়া লইতে চাহিলাম। কিন্তু সামান্য দিবসের নিমিত্ত সেই বাড়ী ভাড়া দিতে তিনি অসম্মত হওয়ায়, পরিশেষে একমাসের নিমিত্তই আমাকে সেই বাড়ী ভাড়া লইতে হইল। কিন্তু যাঁহার বাড়ী, তিনি যে ইহাতেও ন্যায্য ভাড়া গ্রহণ করিলেন, তাহা নহে; নিয়মিত ভাড়া অপেক্ষা প্রায় দ্বিগুণ ভাড়া আমার নিকট হইতে অগ্রিম গ্রহণ করিয়া, তাহার পর তিনি আমার হস্তে সেই বাড়ীর চাবি অর্পণ করিলেন। চাবি আনিয়া আমি সেই বাড়ী খুলিলাম, এবং কতকগুলি আসবাব ভাড়া করিয়া সেই দিবসেই উহার বৈঠকখানা সাজাইয়া ফেলিলাম। গৃহ সাজান হইয়া গেলে, আমি আড়গোড়ায় গমন করিলাম। সেই স্থানে একখানি জুড়িগাড়ি ও একখানি কম্পাস গাড়ি একদিবসের নিমিত্ত ভাড়া করিয়া তাহার অগ্রিম ভাড়া তাহা দিগকে প্রদান করিলাম। তাহাদিগের সহিত আমার এইরূপ বন্দোবস্ত রহিল যে, পরদিবস আমি আড়গোড়ায় গমন করিয়া গাড়ি দুইখানি সঙ্গে করিয়া আনিব।