আমি এই সংবাদ জানিতে পারিয়া একদিবস তাঁহার বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম, এবং তাহার সহিত আমি সাক্ষাৎ করি লাম। আমি বড়বাজারের একজন প্রধান দোকানদার এই কথা বলিয়া আমি সঁহার নিকট আমার পরিচয় প্রদান করিলাম ও কহিলাম, আজ কয়েকদিবস পৰ্য্যন্ত দেখিতেছি, আপনি কতক গুলি দ্রব্যাদি ক্রয় করিবার মানসে দালালগণের সহিত দোকানে দোকানে ঘূরিয়া বেড়াইতেছেন। কিন্তু এ পর্যন্ত কোন দ্রব্যই আপনি ক্রয় করিয়া উঠিতে পারেন নাই। আমার বিশ্বাস, যে পৰ্য্যন্ত সেই দালালগণ আপনাকে পরিত্যাগ না করিবে, সেই পৰ্যন্ত আপনি কোন দ্রব্য ক্রয় করিতে পারিবেন না। কারণ, উঁহারা আপনাকে সঙ্গে করিয়া যে কোন দোকানে লইয়া যাইবে, দোকানদার আপনার নিকট তাহারই চতুগুণ মূল্য চাহিয়া বসিবে। কারণ, সেই দ্রব্য যদি আপনার ক্রয় করা হয়, তাহা হইলে যে সকল দালাল আপনার সহিত সেই সময় সেই স্থানে উপস্থিত ছিল, তাহাদিগের প্রত্যেককেই পৃথক পৃথক্রূপ দালালী সেই দোকানদারকে দিতে হইবে। দোকানদার পূর্বেই সেই অর্থ যদি আপনার নিকট হইতে গ্রহণ না করিবেন, তাহা হইলে তিনি দালালগণকে সন্তুষ্ট করিবেন কোথা হইতে?
আমার নিজের সকল প্রকার দ্রব্যের দোকান আছে বলিয়াই, আমি আপনার নিকট আসিয়াছি। আমি যেরূপ অল্প মূল্যে আপনাকে দ্রব্যাদি দিতে পারিব, বাজারের অপর কোন ব্যক্তিই তাহা পারিবে না। আমার কথায় যদি আপনার বিশ্বাস
হয়, তাহা হইলে দুই একটী দ্রব্যের ফরমাইস আমাকে দিন, সেই দ্রব্য আনিয়া আমি আপনাকে প্রদান করি। আপনি বাজারে যাচাইয়া দেখুন, সেই দ্রব্যের মূল্য কত। তখন আপনি উহার মূল্য আমাকে প্রদান করিবেন। দেখিবেন, বাজার হইতেও কত কম মূল্যে আমি আমার দ্রব্যাদি বিক্রয় করিয়া থাকি।
আমার কথায় তিনি প্রথমতঃ সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস করিলেন বলিয়া অনুমান হইল। কিন্তু পরিশেষে আমাকে কহিলেন, আচ্ছা, আপনি আমার নিমিত্ত এক থান ভাল কিংখাপ কাপড় আনিবেন।
জমিদার মহাশয়ের এই কথা শুনিয়া আমি সেই দিবস আমার বাসায় চলিয়া আসিলাম; এবং কিছু অর্থ সহ বড়বাজারে গমন করিয়া এক থান অতি উৎকৃষ্ট কিংখাপ কাপড় ক্রয় করিয়া সেই দিবস সন্ধ্যার সময় পুনরায় সেই জমিদার মহাশয়ের বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। আমার আনীত কিংখাপ দেখিয়া তাহার বেশ পসন্দ হইল, তিনি উহার দাম জিজ্ঞাসা করিলেন।
উত্তরে আমি কহিলাম, এ কাপড়ের দাম আমি এখন বলিব না। এই কাপড় অদ্য আপনার নিকট রহিল, আপনি ইহা একবার বাজার যাচাইয়া দেখুন, দোকানদারগণ ইহার কি দাম বলিয়া দেয়। আমি কল্য সন্ধ্যার সময় পুনরায় আপনার নিকট আসিব, সেই সময় ইহার দাম আপনাকে বলিব।
আমার প্রস্তাবে জমিদার মহাশয় সম্মত হইলেন, আমিও সেই কাপড় সেই স্থানে রাখিয়া আপনার বাসায় প্রত্যাবর্তন করিলাম।
পরদিবস বৈকালে আমি পুনরায় জমিদার মহাশয়ের বাসায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। তিনি আমাকে দেখিয়া সেই কাপড়ের দাম জিজ্ঞাসা করিলেন।
তাহার কথার উত্তরে আমি কহিলাম, মহারাজ! ইহার দাম আমি প্রথমে বলিব না, পশ্চাতে বলিব। এই কাপড় বাজারে যাচাইয়া ইহার কি দাম আপনি জানিয়াছেন, বা আপ নিইবা ইহার কি দাম দিতে ইচ্ছা করেন, তাহা আমি পূৰ্বে জানিতে ইচ্ছা করি। আপনি ইহা মনে করিবেন না যে, আপনি ইহার দাম আমার ন্যায্য দাম অপেক্ষা অধিক প্রদান করিলে, আমি গ্রহণ করিব। সেই কাপড়ের দাম এই কাগজে লিখিয়া আমি এই স্থানে রাখিয়া দিলাম, আমার ন্যায্য দাম অপেক্ষা যদি আপনি অধিক দাম প্রদান করেন, তাহা হইলে আমি অধিক গ্রহণ করিব না। আমার ন্যায্য দামই আমাকে আপনি প্রদান করিবেন।
এই বলিয়া যে দামে আমি সেই কিংখাপ ক্রয় করিয়া আনিয়া ছিলাম, তাহার অর্ধেক দাম একখানি কাগজে লিখিয়া আমি সেই স্থানে রাখিয়া দিলাম। আমার কথা শুনিয়া জমিদার মহাশয় আমার প্রস্তাবে সম্মত হইলেন। তাঁহার কথার ভাবে অনুমান হইল, কি করে সেই কাপড় লওয়া যাইতে পারে, তাহা তিনি যাচাইয়া রাখিয়াছেন। তিনি আমার কথায় আর কোনরূপ দ্বিরুক্তি না করিয়া যে দরে তিনি সেই কাপড় ক্রয় করিতে পারেন, তাহা আমাকে বলিলেন। আমি দেখিলাম, যে দরে আমি উহা ক্রয় করিয়াছিলাম, তাহার অপেক্ষাও প্রায় এক-চতুর্থ অংশ কম করিয়া উহার দাম বলিলেন।
তাহার কথা শুনিয়া আমি একটু কপট আনন্দ প্রকাশ করিলাম ও কহিলাম, আমি আজ প্রকৃতই একজন খরিদ্দার পাইছি। যে ব্যক্তি দ্রব্যের উপযুক্ত দাম না জানেন, তাহার সহিত কেনা-বেচা করা যে কতদুর কষ্টকর কাৰ্য্য, তাহা যিনি করিয়া ছেন, তিনিই বলিতে পারেন। আপনি যে দাম বলিয়াছেন, তাহা এই বন্ত্রের প্রকৃত দাম; কিন্তু এই দ্রব্য কোন কারণ বশতঃ আমার কিছু কম মূল্যে ক্রয় করা ছিল বলিয়াই, আমি আপনাকে আরও কম মূল্যে দিতে পারিতেছি।
এই বলিয়া যে কাগজে আমি উহার খরিদ মূল্যের অর্ধেক দাম লিখিয়া রাখিয়াছিলাম, সেই কাগজখানি তাহার হস্তে প্রদান করিলাম। আমার লিখিত দর দেখিয়া তিনি অতিশয় সন্তুষ্ট হই লেন, এবং আমার লিখিত মত সেই দ্রব্যের মূল্য তিনি তৎক্ষণাৎ আমাকে প্রদান করিলেন। তদ্ব্যতীত গাড়ি ভাড়া বলিয়া আর দুই টাকা আমাকে দিয়া, অন্য আর একটা দ্রব্যের ফরমাইস দিলেন। পরদিবস সেই দ্রব্য বাজার হইতে ক্রয় করিয়া তাহার নিকট লইয়া গেলাম, এবং আমার খরিদ মূল্য অপেক্ষাও কিছু কম মূল্যে উহা আমি তাহার নিকট বিক্রয় করিলাম। ইহাতে তিনি আমার উপর আরও সন্তুষ্ট হইয়া কহিলেন, আপনি কেবলই কি বস্ত্রের কারবার করিয়া থাকেন, না জহরত-আদিও বিক্রয় করেন?