কালীবাবু ও ত্রৈলোক্য আমাদিগের সহিত সেই সময় সেই স্থানে উপস্থিত ছিল। সেই স্থানের মৃত্তিকা খনন করিতে দেখিয়া তাহাদিগের বাক্যালাপ বন্ধ হইল, মুখ কালিমা বর্ণ ধারণ করিল, চক্ষু যেন ঈষৎ রক্তিমবর্ণ ধারণ করিতে লাগিল। সেই স্থানে কিয়ৎক্ষণ দাঁড়াইয়া, আর তাঁহারা দাড়াইতে পারিল না; নিতান্ত চিন্তিত অন্তঃকরণে সেই স্থানে বসিয়া পড়িল।
সেই স্থান হইতে অধিকাংশ মাটী এইরূপে উঠাইতে উঠা ইতে ক্রমে একটী গলিত মৃতদেহ বাহির হইয়া পড়িল। সেই মৃতদেহ দেখিয়া স্পষ্টই অনুমান হইতে লাগিল, উহা কোন পুরুষের মৃতদেহ। কিন্তু উহা এতদূর বিকৃত ভাব ধারণ করিয়া ছিল যে, উহা কাহার দেহ, তাহা চিনিতে পারা গেল না; কিন্তু আমরা সকলেই অনুমান করিয়া লইলাম, সেই দেহ রামজীলালের দেহ ভিন্ন আর কাহারও দেহ নহে।
মৃত্তিকাগৰ্ভ হইতে সেই মৃতদেহী আমরা সবিশেষ সতর্কতার সহিত উঠাইলাম; দেহ হইতে গলিত মাংস ঋলিত হইতে দিলাম না। সেই দেহ গলিত অবস্থা ধারণ করিয়াছিল সত্য; কিন্তু তাহার পরিধানে যে সকল বস্ত্রাদি ছিল, তাহার একখানিও কোনরূপে নষ্ট হইয়াছিল না।
সেই স্থান হইতে মৃতদেহ বাহির করিবার পর, কালীবাবু ও ত্রৈলোক্যের অবস্থা যে কিরূপ ধারণ করিয়াছিল, তাহার যথাযথ বর্ণনার ক্ষমতা আমার নাই। উঁহাদিগকে দেখিয়া, সেই সময় সহজে অনুমান করা কঠিন হইল যে, উঁহারা জীবিত কি মৃত। দশ বিশ ডাকের কম উঁহাদিগের মুখ হইতে প্রায়ই বাক্য উচ্চারিত হইল না, সহজে কোন কথার উত্তর আর একবারেই পাইলাম না। আমাদিগের প্রশ্নের উত্তরে কেবল উঁহারা বলিতে লাগিল যে, আমরা ইহার কিছুই অবগত নহি। সেই সময়ে আমাদিগের মধ্যে কোন কোন কর্ম্মচারী ত্রৈলোক্যকেই রাণীজি বলিয়া সম্বোধন করিতে লাগিল; কিন্তু ত্রৈলোক্য সেই সকল কথায় কোনরূপ উত্তর প্রদান করিল না।
সেই মৃতদেহ বাহির করিবার পরই একজন কর্ম্মচারীকে বড় বাজারে পাঠাইয়া দেওয়া হইল। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি রামজীলালের মনিব এবং তাহার দোকানের আর কয়েকজন কৰ্ম্ম চারীর সঙ্গে প্রত্যাবর্তন করিলেন। মৃতদেহ দেখিয়া তাঁহারা রামজীলালের দেহ বলিয়া কোনরূপেই চিনিতে পারিলেন না; কিন্তু তাহার পরিহিত বস্ত্রাদি দেখিয়া তাঁহাদিগের আর চিনিতে বাকী থাকিল না। সকলেই একবাক্যে বলিয়া উঠিলেন, এই মৃতদেহ রামজীলালের।
যখন সেই মৃতদেহ রামজীলালের বলিয়া স্থিরীকৃত হইল, তখন যেরূপ ভাবে আমরা এ পর্যন্ত কালীবাবু ও ত্রৈলোক্যকে রাখিয়াছিলাম, এখন আর তাহাদিগকে সেইরূপে রাখিলাম না। এখন তাঁহারা খুনী মোকদ্দমার আসামীরূপে পরিগণিত হইল। এখন উভয়কেই আমরা বন্ধনাবস্থায় রাখিলাম, এবং উভয়কে পৃথক পৃথক স্থানে রাখিয়া পৃথক পৃথকরূপে অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিলাম; কিন্তু ত্রৈলোকের নিকট হইতে কোন কথা প্রাপ্ত হইলাম না। যাহা জিজ্ঞাসা করিলাম, তাহারই উত্তরে সে কহিল, আমি ইহার কিছুই অবগত নহি।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ।
কালীবাবুকে আমরা অতিশয় চতুর বলিয়া মনে করিয়াছিলাম, কিন্তু পরিশেষে দেখিলাম, কালীবাবু অপেক্ষা ত্রৈলোক্যই অতিশয় চতুর। তাহাকে অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিয়া তাহার কোন রূপই উত্তর পাইলাম না; কিন্তু কালীবাবু পরিশেষে আমাদিগের নিকট সমস্ত কথা স্বীকার করিল। আমি তাহাকে কহিলাম, দেখ কালীবাবু! যেরূপ অবস্থায় তোমরা এখন পতিত হইয়াছ, ইহাতে আর তোমাদিগের কোনরূপেই নিষ্কৃতি নাই। তোমার বিপক্ষে যে সকল প্রমাণ সংগৃহীত হইয়াছে, তাহাতে তুমি নিশ্চয়ই বেশ বুঝিতে পারিতেছ যে, এ যাত্রা তোমাকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিতে হইবে। এখন ও তুমি আমার পরামর্শ শুন, এখনও তুমি প্রকৃত কথা-বল। তাহা হইলে তুমি কতদুর দোষী, তাহার যথার্থ অবস্থা আমরা অবগত হইব। নতুবা নিতান্ত অন্ধকারে থাকিয়া আমাদিগকে এই মোকদ্দমা চালাইতে হইবে। দায়ে পড়িয়া এরূপ অনেক বিষয়ের প্রমাণ হয় ত আমাদিগকে করিতে হইবে যে, বাস্তবিক তুমি হয় ত তাহা কর নাই, বা জান না। এই নিমিত্ত আমি তোমাকে বার বার বলিতেছি, তুমি যাহা যাহা করিয়াছ, তাহা আমাদিগকে স্পষ্ট করিয়া বল।
কালী। আচ্ছা মহাশয়! যখন আমি বেশ বুঝিতে পারিতেছি যে, এ যাত্রা যখন কোনরূপেই আমার নিষ্কৃতি নাই, যে কোন উপায়েই হউক, আপনারা আমাদিগকে ফাঁসিতে ঝুলাইবেন, তখন আমি এই ঘটনার প্রকৃত অবস্থা প্রথম হইতে আরম্ভ করিয়া শেষ পর্যন্ত বলিতেছি।
আমি। এ নিতান্ত ভাল কথা।
কালী। কিছু দিবস অতীত হইল, পশ্চিমদেশীয় সেই জমিদার মহাশয় কলিকাতায় আগমন করেন।
আমি। কোন্ জমিদার?
কালী। যে জমিদার মহাশয়ের বাড়ীতে আমি আপনাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়াছিলাম।
আমি। তাহার পর?
কালী। আমি শুনিয়াছিলাম, তাহার বাড়ীতে একটা বিবাহ কাৰ্য্য সম্পন্ন হইবে। সেই বিবাহের নিমিত্ত কতকগুলি ভাল ভাল কাপড় এবং কিছু জহরত ক্রয় করিবার মানসে এবার তিনি কলি, কাতায় আসিয়া উপস্থিত হন। সেই সকল দ্রব্যাদি ক্রয় করিবার মানসে উপযুপরি কয়েকদিবস পর্যন্ত তিনি নিজেই বাজারে গমন করেন, এবং বাজারে ঘূরিয়া ঘূরিয়া তিনি নিতান্ত তক্ত হইয়া পড়েন। বাজারে গমন করিলেই, বাজারে যে সকল দালাল আছে, তাঁহারা আসিয়া তাহার সহিত মিলিত হয়, ও তিনি যে দ্রব্য ক্রয় করিতে চাহেন, সেই দ্রব্য ক্রয় করিয়া দেওয়াইবার মানসে তাহাদিগের পরিচিত যে সকল দোকানে সেই সকল দ্রব্য পাওয়া যায়, সেই সকল দোকানে তাঁহাকে লইয়া গিয়া তাহাকে সেই সকল দ্রব্য দেখায়। সেই সকল দ্রব্যের মধ্যে তাহার যে কোন দ্রব্য পসন্দ হয়, তাহার মূল্য চতুগুণ করিয়া বলিয়া দেয়। এইরূপে কয়েকদিবস পর্যন্ত অনবরত তিনি দালাল গণের সহিত বাজারে বাজারে ঘুরিয়া বেড়ান; কিন্তু কোন দ্রব্যই তিনি খরিদ করিয়া উঠিতে পারেন না।