আমি। এই মোকদ্দমার সহিত বাড়ী ভাড়ার কোনরূপ সংস্রব থাকুক, আর না থাকুক, তুমি অপর কোন বাড়ী ভাড়া করিয়াছিলে কি না, তাহাই আমি জানিতে চাই।
কালী। না।
আমি। তাহা হইলে তুমি ও ত্রৈলোক্য, তোমরা উভয়েই আমার সহিত আগমন কর। তুমি আমাকে দেখাইয়া দেও, আর না দেও, আমি সেই বাড়ী তোমাদিগকে দেখাইয়া দিতেছি।
কালী। আমার একটী সবিশেষ প্রয়োজন আছে, এখন আমি আপনার সহিত গমন করিতে পারিব না।
আমি। আমার সহিত যাইতেই হইবে। সহজে তুমি আমার সহিত না যাও, অসহজে যাইবে।
এই বলিয়া আমি কালীবাবু ও ত্রৈলোক্যকে সঙ্গে লইয়া সেই স্থান হইতে বহির্গত হইলাম। তাঁহারা উভয়েই আমার সহিত গমন করিতে অস্বীকৃত হইয়াছিল; কিন্তু আমি তাহা না শুনিয়া একরূপ বলপ্রয়োগ করিয়াই তাহাদিগকে লইয়া সেই স্থান হইতে বহির্গত হইলাম। আমার সমভিব্যাহারী কেবল একজন কর্ম্মচারী সেই স্থানে রহিলেন মাত্র।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ।
যাহার নিকট হইতে কালীবাবু বাড়ী ভাড়া লইয়াছিলেন, তাহাকে সেই বাড়ীতে আনিবার নিমিত্ত আমি পূৰ্ব্ব হইতেই বন্দোবস্ত করিয়া রাখিয়াছিলাম। কালীবাবু এবং ত্রৈলোক্যকে একখানি গাড়িতে করিয়া লইয়া, যখন আমি সেই বাড়ীর সম্মুখে গিয়া উপস্থিত হইলাম, তখন আমার বেশ অনুমান হইল যে, উভয়েরই হিতাহিত জ্ঞান যেন তিরোহিত হইয়াছে, এবং উহার আমাকে কি বলিবার নিমিত্ত যেন প্রস্তুত হইতেছে। কিন্তু অতি অল্প সময়ের মধ্যে তাঁহারা তাহাদিগের মনের ভাব কতক পরি মাণে পরিবর্তিত করিয়া লইল; যাহা বলিতে যাইতেছিল, তাহা আর বলিল না।
আমাদিগের সেই স্থানে উপস্থিত হইবার একটু পরেই আর একখানি গাড়ি আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইল। উহার মধ্য হইতে দুইজন আরোহী বহির্গত হইলেন। একজন আমারই অধীনস্থ কর্ম্মচারী; অপর ব্যক্তি সেই বাড়ীর অধিকারী। তিনি কালীবাবুকে দেখিয়াই কহিলেন, এই বাবুটাই একমাসের নিমিত্ত আমার বাড়ী ভাড়া লইয়াছিলেন। কালীবাবুকে লক্ষ্য করিয়া কহিলেন, কেমন মহাশয়! এখন আমি এই বাড়ী অপর আর কাহাকেও ভাড়া দিতে পারি?
কালীবাবু তাহার কথায় কোনরূপ উত্তর প্রদান না করিয়া নিতান্ত স্থিরভাবে সেই স্থানে দাঁড়াইয়া রহিল।
বাড়ীর অধিকারী চাবি হস্তে সেই বাড়ীর দরজা খুলিতে গিয়া দেখেন, সেই বাড়ীর সম্মুখে দ্বারবানবেশে একটী লোক বসিয়া রহিয়াছে। তাহাকে দেখিয়াই তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি কে? আমার বাড়ীর দরজায় রসিয়া রহিয়াছ? সেই ব্যক্তি তাহার কথায় কোনরূপ উত্তর প্রদান না করিয়া, আমার ইঙ্গিত অনুসারে সেই স্থান হইতে উঠিয়া একটু দূরে গিয়া দণ্ডায়মান হইলেন। বলা বাহুল্য, সেই ব্যক্তিও আমাদিগের একজন কর্ম্মচারী। আমাদিগের অবর্তমানে কেহ সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতে না পারে, এই নিমিত্তই তাঁহাকে সেই স্থানে পূর্ব হইতেই রাখা হইয়াছিল।
বাড়ীর অধিকারী সেই বাড়ীর চাবি খুলিয়া দিলেন। আমরা সকলেই সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম।
আমরা সকলে সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়া প্রথমতঃ উপরের, এবং পরিশেষে নীচের সমস্ত ঘরগুলি উত্তমরূপে দেখি লাম। দেখিলাম, সমস্ত ঘরগুলিই খালি, কোন ঘরে কিছুই নাই। এই ব্যাপার দেখিয়া সকলেই সেই বাড়ী হইতে বহির্গত হইবার উদ্যোগ করিতেছেন, এরূপ সময়ে নিম্নের একখানি ঘরের দিকে
আমার নয়ন আকৃষ্ট হইল। বলা বাহুল্য, সেই ঘরের ভিতর আমরা পূৰ্বেই গমন করিয়াছিলাম। আমি পুনরায় সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, সেই গৃহের মেয়ের প্রস্তরের একস্থানে কতকগুলি মক্ষিকা ঘন ঘন বসিতেছে। এই ব্যাপার দেখিয়া সেই বাড়ীর অপরাপর গৃহগুলি পুনরায় সবিশেষরূপ লক্ষ্য করিয়া দেখিলাম; কিন্তু আর কোন স্থানে মক্ষিকা বসিতে দেখিতে পাইলাম না। সেই বাড়ীটী নুতন প্রস্তুত হইয়াছিল, উহাতে বে সকল নর্দমা বা ময়লা জল প্রভৃতি ফেলিবার স্থান আছে, সেই সকল স্থানও উত্তমরূপে দেখিলাম; কিন্তু আর কোন স্থানেই মক্ষিকা প্রভৃতি বসিতে দেখিতে পাইলাম না। তখন স্বভাবতই আমার মনে কেমন একরূপ সন্দেহের উদয় হইল। আমি আমার মনের ভাব অপরাপর কর্ম্মচারীগণকেও কহিলাম। সকলেই আমার মতে মত দিয়া কহিলেন, এই স্থানটী একবার ভাল করিয়া দেখি বার প্রয়োজন হইয়াছে। সুতরাং সেই স্থানের প্রস্তর কয়েকখানি একবারে উঠাইয়া ফেলিবার প্রয়োজন হইল।
সেই বাড়ীর অধিকারী মহাশয়কে সেই কথা বলাতে তিনি প্রথমতঃ আমাদিগের প্রস্তাবে অসম্মত হইয়া গৃহের প্রস্তর গুলি উঠাইয়া ফেলিতে নানারূপ আপত্তি করিতে লাগিলেন; কিন্তু আমরা কেহই তাহার আপত্তিতে কর্ণপাত না করিয়া, কোদালি ও সাবল প্রভৃতি সংগ্রহ করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। সেই সকল দ্রব্য সংগ্রহ করিতেও আমাদিগের কোনরূপ কষ্ট হইল না। সেই বাড়ীর একটী গৃহের ভিতর কতকগুলি চুন, সুরকি, বালী এবং সাবল, কোদালি প্রভৃতি রাখা ছিল। সেই স্থান হইতে সাবল ও কোদালি প্রভৃতি আনাইয়া, সেই স্থানের প্রস্তর উঠাইয়া ফেলা হইল। উঠাইবার সময় বেশ অনুমান হইল, উহা যেন একটু আঙ্গা ভাবে বসান রহিয়াছে, এবং যেন নূতন বসান বলিয়া বোধ হইল। সেই স্থানের দুই তিনখানি প্রস্তর উঠাইতে উঠাইতে সেই স্থান হইতে প্রথমে অল্প, এবং পরিশেরে অধিক পরিমাণে দুর্গন্ধ বাহির হইতে আরম্ভ হইল। যখন সেই স্থান হইতে ক্রমে পচাগন্ধ বাহির হইতে লাগিল, সেই সময় আমাদিগের মনে নানারূপ সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইতে লাগিল। সেই সময় আমরা সকলে মিলিয়া শীঘ্র শীঘ্র সেই স্থানের মাটী ক্ৰমে উঠাইয়া ফেলিতে লাগিলাম। সেই স্থানের মৃত্তিকা খনন করিতে আমাদিগের সবিশেষ কোনরূপ কষ্ট হইল না; মাটী যতই উঠাইতে লাগিলাম, ততই যেন উহা আপ্পা বোধ হইতে লাগিল।