কালী। তাহা এখন বুঝিতে পারিয়াছি।
আমি। এখনও তুমি আমাদিগের নিকট মিথ্যা কথা বলিতেছ কি না, তাহাই জানিবার নিমিত্ত তোমাকে আমি জিজ্ঞাসা করি তেছি, সেই জমিদার কে? কারণ, ইতিপূর্বে তুমি আমাদিগের নিকট কয়েকটা কথা মিথ্যা বলিয়াছ।
কালী। আমি সেই জমিদার মহাশয়ের নাম জানি না।
আমি। তিনি কোন্ দেশীয় লোক?
কালী। পশ্চিমদেশীয়।
আমি। পূর্বে কেন বলিয়াছিলে যে, তিনি একজন বঙ্গদেশীয় জমিদার-পুত্র?
কালী। একথা কি আমি পূর্বে বলিয়াছিলাম?
আমি। বলিয়াছিলে।
কালী। যদি বলিয়া থাকি, তাহা হইলে ভুল-ক্রমে বলিয়া থাকিব।
আমি। তুমি যে সময় তাঁহার বাসায় গিয়া জহরত সকল প্রদান কর, সেই সময় সেই স্থানে আর কে ছিল?
কালী। আর কেহ ছিল বলিয়া, আমার মনে হয় না।
আমি। রামজীলাল?
কালী। রামজীলাল ত ছিলই। কিন্তু মহাশয়! রামজীলাল ঠিক সেই সময় তাহার নিকট গমন করেন নাই, তিনি বাহিরে ছিলেন।
আমি। রামজীলালকে বাহিরে রাখিয়া তুমি একাকীই বাড়ীর ভিতর গমন করিয়াছিলে?
কালী। হাঁ।
আমি। জমিদার মহাশয়ের নিকট হইতে টাকা আনিয়া তুমিই রামজীলালের হস্তে প্রদান কর?
কালী। হাঁ। আমি। জমিদার মহাশয় এখন সেই বাড়ীতে আছেন কি?
কালী। আজ কয়েকদিবস পর্যন্ত আমি সেদিকে যাই নাই। বোধ হয়, থাকিতে পারেন।
আমি। সেই বাড়ীটা তুমি এখন আমাকে দেখাইয়া দিতে পার?
কালী। পারিব না কেন? তবে জিজ্ঞাসা করি, যখন আপনার সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হইয়াছে, তখন আপনি ত তাহার সেই বাড়ী জানেন।
আমি। আমার সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হয় নাই। অপর আর একজন কর্ম্মচারীকে আমি তাঁহার নিকট পাঠাইয়াছিলাম। সেই কর্ম্মচারীকে তিনি যাহা বলিয়াছেন, কেবল তাহাই আমি অবগত আছি মাত্র। আমি নিজে সেই বাড়ী চিনি না, এই নিমিত্তই সেই বাড়ী দেখাইয়া দিবার নিমিত্ত আমি তোমাকে বলিতেছি। যে কর্ম্মচারী সেই বাড়ী দেখিয়া আসিয়াছিলেন, তিনিও এখন এখানে নাই। অপর কোন কাৰ্য্য উপলক্ষে স্থানান্তরে গমন করিয়াছেন।
কালী। তাহা হইলে চলুন, আমি আপনার সহিত গমন করিয়া সেই বাড়ী আমি আপনাকে দেখাইয়া দিতেছি।
কালীবাবুর কথা শুনিয়া আমি সেই স্থানে আর কালবিলম্ব করিলাম না। তাহাকে লইয়া তখনই সেই স্থান হইতে বহির্গত হইলাম। আমি মনে করিয়াছিলাম, আড়গোড়ার সহিসের সাহায্যে আমরা যে বাড়ীর অনুসন্ধান পাইয়াছিলাম, কালীবাবু সেই বাড়ীই আমাদিগকে দেখাইয়া দিবেন; কিন্তু পরে দেখিলাম, আমি যাহা ভাবিয়াছিলাম, কালীবাবু সেই বাড়ী আমাদিগকে দেখাইয়া না দিয়া, অন্য স্থানে অপর একখানি বাড়ী দেখাইয়া দিল। সেই বাড়ীর দরজায় একজন দ্বারবান্ বসিয়া আছে দেখিয়া, তাহাকে দুই একটী কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। তাহার নিকট হইতে অবগত হইলাম যে, তাহার মনিব পশ্চিমদেশীয় একজন জমিদার সেই বাড়ীতে ছিলেন; কিন্তু কয়েকদিবস হইল, তাঁহার দেশে গমন করিয়াছেন। আরও জানিতে পারিলাম যে, কালীবাবু সেই দ্বারবানের নিকট পরিচিত। দ্বারবান তাহার মনিবের নিকট অনেকবার কালীবাবুকে দেখিয়াছে। দ্বারবান্ ইহাও বলিল যে, কালীবাবুর নিকট হইতে তাহার মনিব অনেকগুলি মূল্যবান, কাপড় ও জহরত খরিদ করিয়াছেন।
দ্বারবানের নিকট আমি এই সকল কথা অবগত হইয়া আমি পুনরায় কালীবাবুর সঙ্গে তাহার বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।
কালীবাবুর বাড়ীতে উপস্থিত হইয়া আমি পুনরায় তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, কালীবাবু! তুমি পূর্ব হইতে এ সম্বন্ধে এত মিথ্যা কথা বলিয়া আসিতেছ কেন?
কালী। কেন মহাশয়! আমি কি মিথ্যা কথা কহিলাম?
আমি। আবার বলিতেছ, আমি কি মিথ্যা কথা কহিলাম? যে ব্যক্তি জহরত খরিদ করিয়াছেন, তিনি পূর্বে বঙ্গদেশীয় একজন জমিদার-পুত্র ছিলেন। কিন্তু এখন দেখিতে দেখিতে তিনি একজন পশ্চিমদেশীয় জমিদার হইয়া পড়িলেন?
কালী। উনি বাঙ্গালি কি পশ্চিমদেশীয় লোক, তাহা আমি সেই সময় ঠিক বুঝিয়া উঠিতে পারি নাই।
আমি। ভাল, ইহাই যেন বুঝিতে না পারিয়াছিলে; কিন্তু যাহার বাড়ী তুমি পূৰ্ব্বে জানিতে না, এখন তাহার বাড়ী তুমি কিরূপে আমাকে দেখাইয়া দিতে সমর্থ হইলে?
কালী। তাহার বাড়ী আমি চিনি না, একথা যদি পূর্বে আমি আপনাকে বলিয়া থাকি, তাহাও ভুল-ক্রমে বলিয়া থাকিব।
আমি। ইহাও যদি তুমি ভুল-ক্রমে বলিয়া থাক, তাহা হইলে তুমি পূর্বে কিরূপে বলিয়াছিলে যে, জহরতগুলি সেই জমিদার মহাশয় রামজীলালের নিকট হইতে ত্রৈলোকের ঘরে বসিয়া খরিদ করেন, অথচ এখন দেখিতেছি, তুমি তাহার বাড়ীতে গিয়া তাহার নিকট সেই জহরতগুলি বিক্রয় করিয়া আসিয়াছ? ইহার কোন কথা প্রকৃত?
কালী। ইহার উভয় কথাই প্রকৃত। আমি পূর্বেও বলিয়া ছিলাম, এখনও বলিতেছি যে, আমার কথা সমস্তই প্রকৃত। ইহার মধ্যে একটীও মিথ্যা কথা নাই। আমি জহরতগুলি সেই জমিদার মহাশয়ের বাড়ীতে গিয়া বিক্রয় করিয়া আসি সত্য; কিন্তু টাকা গুলি ত্রৈলোক্যের এই গৃহে বসিয়া আমি রামজীলালের হস্তে প্রদান করি। তিনি উহা উত্তমরূপে গণিয়া-গাথিয়া লইয়া সেই স্থান হইতে চলিয়া যান।
আমি। একথা ত ঠিক নহে, তুমি প্রথমে বলিয়াছিলে, জমিদার-পুত্র ত্রৈলোকের গৃহে বসিয়া সেই সকল জহরত খরিদ করেন, এবং সেই স্থানেই তিনি তাহার মূল্য রামজীলালের হস্তে প্রদান করেন।