মনে মনে এইরূপ ভাবিলাম সত্য; কিন্তু কাহাকেও কিছু না বলিয়া, সেই নোটগুলি করেনসি আফিসে প্রত্যর্পণ-পূৰ্ব্বক আস্তে আস্তে সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম।
কালীবাবুর অবস্থা আমি উত্তমরূপে জানিতাম। তাহার নিজের গাড়ি-ঘোড়া নাই, অথচ আড়গোড়া হইতে গাড়ি ভাড়া করিয়া তাহাতে চড়িবার ক্ষমতাও তাহার নাই। এরূপ অবস্থায় কাহার গাড়িতে চড়িয়া সে বাজারে আগমন করিয়াছিল, ক্রমে তাহা জানি বার প্রয়োজন হইয়া পড়িল। রাণীজিই বা কে? সেই জুড়িই বা কাহার? এবং কেইবা সেই জুড়ি আড়গোড়া হইতে ভাড়া করিয়া চড়িয়াছিল, তাহা জানিতে পারিলেই কালীবাবুর কথা যে কতদূর সত্য, তাহা অনায়াসেই অনুমান করা যাইতে পারে। কালীবাবু যে জমিদার-পুত্রের কথা বলিতেছে, তিনি যে কে, তাহা কালীবাবুর জানিতে না পারার কোনরূপ অসম্ভাবনা দেখিতেছি না। যে ব্যক্তি তাহারই রক্ষিতা স্ত্রীলোকের গৃহে আসিয়া আমোদ প্রমোদ করে, যে ব্যক্তি তাহারই গৃহে বসিয়া এত টাকা মূল্যের জহরতাদি খরিদ করে, তাহার পরিচয় কালীবাবু যে একবারেই জানে না, ইহা কিছুতেই বিশ্বাস হইতে পারে না। অন্ততঃ তিনি যে কোথায় থাকেন, তাহা কালীবাবু বা ত্রৈলোক্য যে একবারেই অবগত নহে, তাহাও আমি কোনরূপেই বিশ্বাস করিতে সমর্থ নহি। আমার অনুমান হইতেছে, কালীবাবু যে সকল কথা আমাদিগকে বলিয়াছে, তাহার অধিকাংশই মিথ্যা কথা। সুতরাং এ সম্বন্ধে আমাকে আরও একটু সবিশেষরূপ অনুসন্ধান করিতে হইবে।
এইরূপ ভাবিতে ভাবিতে আমি আমার থানায় প্রত্যাবর্তন করিলাম। থানার মধ্যে সেই সময় যে সকল ডিটেকটিভ-কর্ম্মচারী উপস্থিত ছিলেন, তাঁহাদিগের মধ্য হইতে পশ্চিমদেশীয় এরূপ এক কর্ম্মচারীকে আমি আমার সঙ্গে লইলাম যে, তাঁহাকে সহিসের বেশ পরিধান করাইলে, ঠিক সহিসের মতই বোধ হয়।
সেই কর্ম্মচারীকে আমি সামান্য সহিসের বেশে সজ্জিত হইয়া আমার সহিত আসিতে কহিলাম। তিনি আমার আদেশ মত সহিসের বেশ ধরিয়া আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন।
বড়বাজারের যে দোকানে রাণীজির জুড়ি এবং কালীবাবুর কম্পাস পাড়ি গমন করিয়াছিল, সেই দোকানের লোজনদিগের নিকট হইতে সেই গাড়ির সহিস-কোচবানগণের পোযাকের বিবরণ শুনিয়া আমি সেই সময়েই স্থির করিয়াছিলাম যে, সেই দুইখানি গাড়ি কোন আড়গোড়া হইতে আনীত হইয়াছে। কারণ, কলিকাতার পাঠকগণের মধ্যে অনেকেই অবগত আছেন যে, কলিকাতার প্রত্যেক আড়গোড়ার সহিস-কোচবানদিগের পরিচ্ছদ এক এক প্রকার।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ।
সহিস-বেশধারী কর্ম্মচারীকে সঙ্গে লইয়া আমি থানা হইতে বহির্গত হইলাম। সহিস-কোচবানের পোষাক পরিচ্ছদের বিবরণ শুনিয়া আমি মনে মনে যে আড়গোড়া স্থির করিয়াছিলাম, সেই আড়গোড়ায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। আমি সেই আড়গোড়ার ভিতর একটী ঘোড়া ক্রয় করিবার ছলে প্রবেশ করিয়া আড়গোড়ায় যে সকল ঘোড়া ছিল, তাহাই দেখিবার ভানে এদিক ওদিক বেড়াইতে লাগিলাম; কিন্তু সহিস-বেশধারী কর্ম্মচারীর দৃষ্টিপথের বাহির হইলাম না। অধিকন্তু অপরাপর সহিস-কোচবানদিগের সহিত সেই কৰ্মচারীর যে সকল কথা হইতে লাগিল, তাহার দিকেও সবিশেষরূপ লক্ষ্য রাখিলাম।
সহিস-বেশধারী কর্ম্মচারী আমার উপদেশ মত আড়গোড়ার ভিতর প্রবেশ করিয়া যে স্থানে কয়েকজন সহিস-কোচবান বসিয়া ছিল, সেই স্থানে উপস্থিত হইলেন, এবং আপনাকে একজন সহিস বলিয়া পরিচয় দিয়া তাহাদিগের নিকট উপবেশন করিলেন। তাহাকে দেখিয়া একজন কোচবান্ জিজ্ঞাসা করিল, তুমি কাহার অনুসন্ধান করিতেছ?
কৰ্ম্মচারী। কাহারও অনুসন্ধান করিতেছি না।
কোচবান্। তবে এখানে আসিয়াছ কেন?
কর্ম্মচারী। আমি বরাবর সহিসী কৰ্ম্ম করিতাম; কিন্তু আজ কয়েকমাস হইল, আমি আমার দেশে গমন করিয়াছিলাম, এবং কিছু দিন পূর্বে আমি দেশ হইতে প্রত্যাবর্তন করিয়াছি। এখন কোন স্থানে কোনরূপ চাকরী যোগাড় করিতে না পারায়, সবিশেষরূপ কষ্ট পাইতেছি। তাই একটা চাকরীর অনুসন্ধানে আপনাদিগের এখানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি।
কোচবান। এখানে তোমার চাকরী হইতে পারে, একথা তোমাকে কে বলিল?
কর্ম্মচারী। একথা আমাকে কেহ বলে নাই। আড়গোড়ায় অনেক সহিস কাৰ্য্য করে; সুতরাং সময় সময় অনেক চাকরী প্রায়ই খালি খাকার সম্ভাবনা। তাই আপনাদিগের এখানে আগমন করিয়াছি। এখন বলুন, কিরূপ উপায়ে আমি একটা চাকরী যোগাড় করিতে সমর্থ হই?
কোচবান্। আমাদিগের এখানে যদি কোন কৰ্ম্ম খালি থাকিত, তাহা হইলে আমাদিগের সাহেবকে বলিয়া যাহাতে তুমি কোন একটী কৰ্ম্ম পাইতে পারিতে, আমি তাহার বন্দোবস্ত করিতাম; কিন্তু আজকাল সহিসের কাৰ্য খালি থাকা দূরে থাকুক, দুই একজন সহিস আমাদিগের এখানে ফালতু পড়িয়া আছে।
কর্ম্মচারী। এখানে বড় আশা করিয়া আসিয়াছিলাম, কিন্তু এখন দেখিতেছি, আমার সে আশা এখন কার্যে পরিণত হওয়া কঠিন হইয়া দাঁড়াইল।
কোচবান্। এখানে মধ্যে মধ্যে প্রায়ই সহিসী কাৰ্য্য খালি হইয়া থাকে। তুমি দুই একদিবস অন্তর এক একবার আসিও, খালি হইলেই আমি তোমার জন্য একটী যোগাড় করিয়া দিব।
কর্ম্মচারী। তাহাই হইবে। আমি মধ্যে মধ্যে আসিয়া আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিব। আজ কয়েকদিবস হইল, বড়বাজারে একখানি জুড়ি গাড়ি এবং একখানি কম্পাস গাড়ি আপনাদিগের এখান হইতে গিয়াছিল, তাহাদিগের মধ্যে কোন সহিস কোচবানের সহিত একবার সাক্ষাৎ হয় কি?