কর্ম্মচারী। কি?
আমি। রামজীলালকে সবিশেষরূপে অনুসন্ধান করিয়া তাহাকে ধরিতে হইবে।
কর্ম্মচারী। আর কিছু?
আমি। সেই জমিদার-পুত্র যে কে, অনুসন্ধান করিয়া তাহার ঠিকানা করিতে হইবে।
কর্ম্মচারী। এই সকল বিষয় অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত আমি এখন প্রস্তুত হইতে পারি কি?
আমি। এই সকল বিষয়ের অনুসন্ধানের নিমিত্ত আপনি এখন যে স্থানে ইচ্ছা সেই স্থানে গমন করিতে পারেন। কিন্তু আপনি বহির্গত হইয়া যাইবার পূর্বে আর একটা কাৰ্য্য আপনাকে করিতে হইবে।
কর্ম্মচারী। কি?
আমি। আমার সহিত কালীবাবুর বাড়ীতে একবার গমন করিয়া কালীবাবু ও ত্রৈলোক্যকে আমাকে দেখাইয়া দিতে হইবে। কারণ, তাঁহারা যে কে, এবং কি চরিত্রের পোক, সেই সম্বন্ধে আমি সময় মত একবার উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিয়া দেখি; এবং সেই বাড়ীর অপর ভাড়াটিয়াগণের মধ্যে যদি কেহ সেই জমিদার-পুত্রের কোনরূপ সন্ধান করিয়া উঠিতে পারেন, তাহারও সবিশেষরূপ চেষ্টা করিয়া দেখিব।
আমার কথায় কর্ম্মচারী মহাশয় সম্মত হইলেন। আমার অবকাশ মত তিনি আমার সহিত গমন করিয়া, কালীবাবু ও তাহার উপপত্নী ত্রৈলোক্যকে আমাকে দেখাইয়া দিবেন, ইহাই স্থিরীকৃত হইল।
আমি অতিশয় ক্লান্ত ছিলাম; সুতরাং সেই দিবসেই আমি আর কালীবাবুর বাড়ীতে গমন করিতে পারিলাম না।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ।
পরদিবস অতি প্রত্যূষে সেই কর্ম্মচারীকে সঙ্গে করিয়া আমি কালীবাবুর বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। কালীবাবু এবং ত্রৈলোক্য উভয়েই সেই সময় তাহাদিগের গৃহে উপস্থিত ছিল। কালীবাবু আমাকে দেখিয়া, সম্পূর্ণরূপে চিনিতে পারিলেন কি না, তাহা বলিতে পারি না; কিন্তু আমি তাঁহাকে অতি উত্তমরূপে চিনিতে পারিলাম। কালীবাবু যে চরিত্রের লোক, ত্রৈলোক্যের সহিত মিলিত হইয়া নিতান্ত অসৎবৃত্তি অবলম্বন করিয়া সে একাল পর্যন্ত তাহাদের উভয়ের জীবিকা নির্বাহ করিয়া আসিতেছিল, তাহা অতি উত্তমরূপেই অবগত ছিলাম। আমি জানিতাম, দশ হাজার টাকার মূল্যের জহরত খরিদ করিবার ক্ষমতা কালীবাবুর নাই। আরও জানিতাম, কালীবাবুকে যে জানিত, সে দশ হাজার টাকা ত দূরের কথা, দশ পয়সাও দিয়া কালীবাবুকে সহজে বিশ্বাস করিত না।
আমি কালীবাবুর বাড়ীতে গমন করিয়া কেবল রামজীলাল সম্বন্ধে দুই একটা কথা জিজ্ঞাসা করিলাম মাত্র। সবিশেষ কোন কথা তাহার নিকট ভাঙ্গিলাম না, বা তাহার মনে কোনরূপ সন্দেহ হইতে পারে, এরূপ কোন কথাও তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম না। আমার কথায় কালীবাবু, যে কোন উত্তর প্রদান করিলেন, তাহাতেই যেন আমি সন্তুষ্ট হইয়া, রামজীলালের অনুসন্ধান করি বার ভান করিয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম।
যে সময় কালীবাবু ও ত্রৈলোক্যের সহিত আমার দুই চারিটী কথা হইয়াছিল, সেই সময় উঁহারা যদি সবিশেষ মনোযোগের সহিত আমার দিকে লক্ষ্য রাখিত, তাহা হইলে উঁহারা সেই সময় আমার কথার উত্তর প্রদান করিতে পারিত কি না, তাহা বলিতে পারি না। কারণ, সেই সময় যেরূপ সতর্কতার সহিত আদি উহা দিগের আপাদমস্তক দর্শন করিতেছিলাম, উঁহারা যদি ঘূণাক্ষরেও আমার সেই সূক্ষ্ম দর্শনের অর্থ বুঝিতে পারি, তাহা হইলে আমি নিশ্চয় বলিতে পারি যে, সেই সময় উঁহারা আমার সম্মুখীন হইয়া কখনই আমার সহিত বাক্যালাপে প্রবৃত্ত হইতে পারি?
না। তাহাদিগের পাপরাশীর ভয়ানক অবস্থা আমি বুঝিতে পারিয়াছি, সেই ভাবিয়া কখনই তাঁহারা কোন পুলিস-কর্ম্মচারীর সম্মুখীন হইতে সাহসী হইত না।
আমার অভিসন্ধির বিষয় যদিও তাঁহারা পূৰ্ব্বে কিছুমাত্র বুঝিতে পারিয়াছিল না; কিন্তু পরিশেষে তাঁহারা আমার সেই সূক্ষ্ম দর্শনের অথ সবিশেষরূপে বুঝিতে সমর্থ হইয়াছিল।
উঁহাদিগকে যে দুই চারিটী কথা আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, এবং তাহার উত্তরে উঁহারা আমাকে যাহা কিছু বলিয়াছিল, তাহার কোন কথাই আমি বিশ্বাস করিতে সমর্থ হইলাম না। অধিকন্তু উঁহাদিগের উপর নানারূপ সন্দেহ আসিয়া আমার মনে উদয় হইল। বস্তুতঃ আমার সমভিব্যাহারী কর্ম্মচারী যেরূপ ভাবে অনুসন্ধান করিয়া রামজীলালের উপর ওয়ারেন্ট বাহির করিয়া রাখিয়াছিলেন, সেই অনুসন্ধানে আমি সন্তুষ্ট হইতে পারিলাম না।
এ সম্বন্ধে আরও একটু সবিশেষরূপ অনুসন্ধান করা আবশ্যক, মনে মনে এইরূপ বিবেচনা করিলাম। কিন্তু কোন উপায় অব লম্বন করিলে, সেইরূপ অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইতে পারি, ভাবিয়া। চিন্তিয়া তাহার কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া, আমরা উভয়েই থানায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম।
থানায় আসিবার প্রায় দুই তিনঘন্টা পরে হঠাৎ একটা বিষয় জানিবার ইচ্ছা আমার মনে উদয় হইল। এ সম্বন্ধে আমি কাহাকেও কিছু না বলিয়া, সেই কর্ম্মচারীকে সঙ্গে লইয়া করেপি আফিসে গিয়া উপস্থিত হইলাম। ইতিপূর্বে যে কয়েকখানি নম্বরি নোট করেনসি আফিসে ভাঙ্গাইয়া লইয়া রামজীলাল প্রস্থান করিয়াছে—সাব্যস্ত হইয়াছিল, করেসি অফিসের বড় সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া, সেই নোট কয়েকখানি একবার দেখিতে চাহিলাম। তিনি তাহার অধীনস্থ কর্ম্মচারীকে আদেশ প্রদান করিলেন, সেই কৰ্ম্মচারী অনুসন্ধান-পূৰ্ব্বক সেই নোট কয়েকখানি বাহির করিয়া আনিয়া আমার হস্তে প্রদান করিলেন। সেই নোট দেখিয়া আমি যে কতদুর বিস্মিত হইলাম, তাহা বলিতে পারি না। কারণ, যে সন্দেহের উপর নির্ভর করিয়া, আমি সেই নোটগুলি দেখিবার ইচ্ছা করিয়াছিলাম, এখন দেখিলাম, সেই সন্দেহ বিশ্বাসে পরিণত হইল। ইতিপূর্বে অনুসন্ধানে আমি অবগত হইতে পারিয়াছিলাম যে, রামজীলাল একজন পশ্চিমদেশীয় লোক, বঙ্গদেশে থাকিয়া ব্যবসা-কাৰ্য্য করিয়া থাকেন বটে; কিন্তু বঙ্গ ভাষার সহিত তাহার কিছুমাত্র সংশ্রব নাই। তিনি না পারেন বাঙ্গালা কহিতে-না পারেন বাঙ্গালা লিখিতে। এখন দেখিলাম, সেই নোটগুলির উপর রামজীলালের নাম স্বাক্ষর আছে সত্য; কিন্তু উহা হিন্দীভাষায় নাই, বাঙ্গালা ভাষায়। রামজীলাল যখন বাঙ্গালা ভাষা একবারেই অবগত নহেন, তখন তিনি বাঙ্গালা ভাষায় আপনার নাম কিরূপে স্বাক্ষর করিলেন, তাহার কিছুই বুঝি উঠিতে পারিলাম না। আরও ভাবিলাম, রামজীলাল যখন সেই সকল অর্থ অপহরণ করিয়া পলায়ন করিতেছে, তখন সে যে আপনার নাম ও ঠিকানা স্পষ্ট করিয়া লিখিয়া দিয়া তাহার বিপক্ষে প্রমাণ সংগ্রহ করিয়া রাখিয়া যাইবে, তাহাই বা সহজে বিশ্বাস করি কি প্রকারে?