আগন্তুক। আমি কন্যাদায়গ্রস্ত বলিয়াই আপনার নিকট আসিয়াছি।
সনাতন। আপনার কন্যাটা কেমন? এবং তাহার বয়সই বা এখন কত হইয়াছে?
আগন্তুক। আপনি যেরূপ চাহিতেছেন, তাহাই। আমার কন্যা এগার বৎসর অতিক্রম করিয়া, বার বৎসরে উপনীত হই আছে। দেখিলে জানিতে পারিবেন, এরূপ সুশ্রী কন্যা এক হাজার কন্যার মধ্যে একটী পাওয়া যায় কি না। এই নিমিত্ত আমার প্রার্থনা, আপনি আমার সেই কন্যাটীকে একবার স্বচক্ষে দর্শন করুন।
সনাতন। আপনার নিবাস কোথায়?
আগন্তুক। বর্ধমান জেলার অন্তর্গত * * গ্রামে।
সনাতন। আচ্ছা মহাশয়! আপনি কল্য আমার নিকট আগমন করিবেন, হয় আমি নিজে আপনার সহিত গমন করিব, হয়, অপর কোন এক ব্যক্তিকে আপনার সহিত যাইতে বলিব, তিনি গিয়া দেখিয়া আসিলেই হইবে।
আগন্তুক। আমি সাহস করিয়া বলিতে পারি, আমার কন্যা যিনি দেখিবেন, তাহারই মনোনীত হইবে। কিন্তু পূর্বে একবার দেনা-পাওনার কথাটী বলিলে হইত না? তাহা হইলে আমি জানিতে পারিতাম, সেই পরিমিত টাকার সংস্থান করিবার ক্ষমতা আমার আছে কি না।
সনাতন। কন্যা মনোনীত হইলে, দেনা-পাওনার নিমিত্ত ততটা বাধা রহিবে না। তবে কি না, যেরূপ বিদ্বান্ বালকের হস্তে আপনি কন্যাদান করিতে প্রবৃত্ত হইতেছেন, তাহাতে একবারেই যে কিছু লাগিবে না, তাহা নহে। অগ্রে কন্যা মনোনীত হউক, তাহার পর সকল বিষয় সহজেই মিটিয়া যাইবে।
আগন্তুক। আচ্ছা মহাশয়? তাহাই হইবে। আমি কল্য অতি প্রত্যূষে আপনার নিকট আগমন করিব; কিন্তু আমার ইচ্ছা, আপনি নিজে গিয়া আমার কন্যাটীকে স্বচক্ষে দর্শন করেন।
সনাতন। আচ্ছা দেখিব, পারি যদি আমি নিজেই যাইব।
আগন্তুক। মহাশয়! আমি আর একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা করি।
সনাতন। কি?
আগন্তুক। আপনার পুত্রটী এখন কোথায়?
সনাতন। বাড়ীতেই আছে।
আগন্তুক। তাহাকে একবার আমি দেখিতে পাই কি?
সনাতন। কেন পাইবেন না? আপনি যাহাকে জামাতা করিতে চাহিতেছেন, তাহাকে দেখিতে পাইবেন না, একথা কি হইতে পারে? আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমি তাহাকে আপনার সম্মুখে এখনই আনিতেছি।
এই বলিয়া সনাতন বাটীর ভিতর প্রবেশ করিলেন, এবং কিছু পরেই তাঁহার সেই মূখ ও বেশ্যাসক্ত পুত্র সতীন্দ্রনাথকে সঙ্গে করিয়া আনিয়া, তাহাকে কহিলেন, মহাশয়! ইনিই আমার পুত্র। আমি অনেক কষ্টে ইহাকে লেখা পড়া শিখাইয়াছি। ইনিই এবার দশ হাজার টাকা পারিতোষিক পাইয়াছেন।
সনাতনের এই কথা শুনিয়া আগন্তুক একবার তাহার আপাদ-মস্তক নিরীক্ষণ করিলেন, এবং তাহাকে কহিলেন, বাবা! তোমার নাম কি?
সতীন্দ্রনাথ অবলীলাক্রমে কহিল, আমার নাম শচীন্দ্রনাথ। সে যে এই মিথ্যা কথা আপনার ইচ্ছানুযায়ী কহিল, তাহা নহে। পিতার শিক্ষামতই সে তাহার মিথ্যা নাম বলিয়া আপনার পরিচয় প্রদান করিল।
আগন্তুক পাত্র দেখিয়া সন্তুষ্ট হইলেন ও কহিলেন, বেশ ছেলে। সনাতনকে কহিলেন, আপনি বলিতেছিলেন, আপনার পুত্রের বয়স কিছু অধিক হইয়াছে। কৈ, আমার বিবেচনায় ইহার বয়ঃক্রম কিছুমাত্র অধিক হয় নাই; বিবাহের উপযুক্ত বয়সই এখন হইয়াছে। আমার কন্যার সহিত ইহাকে বেশ মানাইবে। এই বলিয়া তিনি সতীন্দ্রকে কহিলেন, যাও বাবা। তুমি এখন বাড়ীর ভিতর গমন কর। সতীন্দ্রনাথ সেই স্থান হইতে উঠিয়া অন্য স্থানে প্রস্থান করিল।
সতীন্দ্রনাথ দেখিতে নিতান্ত মন্দ ছিল না। তাহাকে দেখিয়া আগন্তুকের বেশ পসন্দ হইল। তাহার উপর সে যেরূপ উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত শুনিলেন, তাহাতে এরূপ পাত্রকে কে পসন্দ না করিয়া থাকিতে পারে?
পরদিবস সনাতন কন্যার পিতার সহিত বর্ধমানে গমন করিয়া কন্যাটী দেখিয়া আসিলেন। দেখিলেন, কন্যাটী অতি সুরূপা, ও বয়ঃক্রম প্রায় তের বৎসর। কন্যাটা দেখিয়া সনাতন তাহার পিতাকে কহিলেন, আপনার কন্যাটী সুশ্রী, ইহাকে আমি আমার পুত্রবধূ করিতে পারি। কিন্তু এখন দেনা-পাওনার বিষয়টা কি হইবে?
কন্যার পিতা। আমার অবস্থা ত আপনি স্বচক্ষে দেখিয়া গেলেন। আপনাকে এখানে আনিবার আমার প্রধান উদ্দেশ্য, আমার অবস্থা আপনাকে দেখান। এখন বিবেচনা-মত আপনি যাহা কহিবেন, তাহাই আমি আপনাকে প্রদান করিতে প্রস্তুত আছি। কারণ, আপনার পুত্রের সদৃশ বিদ্বান্ পাত্রের হস্তে কন্যা সমৰ্পণ করিতে কোন ব্যক্তি পরাজুখ হয়েন? তবে আমার প্রতি একটু অনুগ্রহ করিবেন, এই প্রার্থনা।
সনাতন। দেখুন মহাশয়। আমার পুত্র নিজেই দশ হাজার টাকা পারিতোষিক পাইয়াছে। কনটী যখন আমার একরূপ পসন্দ হইয়াছে, তখন টাকার নিমিত্ত আমি তত পীড়াপীড়ি করিব না। তবে এখন বিবেচনা মত আপনি নিজেই বলিয়া দিন, আপনি অলঙ্কার-পত্র প্রভৃতি সমস্ত দ্রব্যের জন্য মোট আমাকে কত টাকা দিতে পারিবেন?
কন্যার পিতা। মহাশয়! সৰ্ব্ব শুদ্ধ আমি এক হাজার পাঁচশত টাকা আপনাকে প্রদান করিব। ইহাতেই অনুগ্রহ করিয়া আমার উপর আপনাকে সদয় হইয়া, কন্যাদায় হইতে আমাকে উদ্ধার করিতে হইবে।
সনাতন। অত কম টাকায় কিরূপে আপনি এইরূপ সুপাত্র পাইতে পারেন? আমি অধিক টাকা চাহিতেছি না, সর্ব শুদ্ধ আমাকে দুই হাজার পাঁচশত টাকা প্রদান করিবেন।
সনাতনের এই কথা শুনিয়া কন্যার পিতা অনেক তোষামোদ করিয়া পরিশেষে সনাতনকে দুই হাজার টাকায় সম্মত করাইলেন।