সনাতনের তৃতীয় পুত্রের নাম শচীন্দ্রনাথ। অতিশয় বুদ্ধিমান্, এখনকার কালে লেখাপড়ায় যতদূর উৎকৃষ্ট হইতে হয়, তাহা হইয়াছে। এণ্টেন্স হইতে আরম্ভ করিয়া, এল-এ, বি-এ, এম-এ প্রভৃতিতে সর্বোচ্চ হইয়া আসিয়াছে। এবার স্টুডেন্টশিপ পরীক্ষায় পাস হওয়াতে, তাহাকে দশ হাজার টাকা পারিতোষিক দিবার জন্য শিক্ষা বিভাগ আদেশ প্রদান করিয়াছেন।
এই সংবাদ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হইবার পরই শচীন্দ্রের সহিত নিজ নিজ কন্যার বিবাহ দিবার নিমিত্ত চারিদিক হইতে কন্যাকৰ্ত্তাগণ সনাতনের বাটীতে আসিতে আরম্ভ করিলেন। কেহবা বংশের প্রলোভন দেখাইয়া, কেহবা অর্থের প্রলোভন দেখাইয়া, এবং কেহ সুশ্রী বালিকার প্রলোভন দেখাইয়া, সনাতন বাবুর নিকট শচীন্দ্রের বিবাহের কথা উত্থাপন করিতে লাগিলেন। সনাতন বাবু পুরাতন দালাল। তিনি কাহাকেও কোনরূপে অসন্তুষ্ট না করিয়া, বা কাহাকেও কোনরূপ পরিষ্কার উত্তর না দিয়া, সকলকেই হাতে রাখিলেন।
পূর্বে তিনি সতীন্দ্রনাথের বিবাহের নিমিত্ত অনেক চেষ্টা করিয়া ছিলেন; কিন্তু কোনরূপেই কৃতকার্য হইতে পারেন নাই। এখন শচীন্দ্রনাথের বিবাহের উপলক্ষে তাহার মনে নানাপ্রকার চিন্তা আসিয়া উপস্থিত হইতে লাগিল। প্রথম চিন্তা, এই সময় পুনৰ্বার সতীন্দ্রনাথেরও বিবাহের চেষ্টা করেন। একটী বড় বালিকার সহিত তাহার বিবাহ দিতে না পারিলে, উহার চরিত্র সংশোধনের আর কোনরূপ উপায় নাই। দ্বিতীয় চিন্তা, শচীন্দ্র নাখের বিবাহের সময় উপস্থিত হইয়াছে। এই সময়ে তাহার বিবাহ দেওয়াও সম্পূর্ণরূপে কৰ্তব্য; কিন্তু তাহার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা সতীন্দ্রনাথের বিবাহ অগ্রে না হইলে কনিষ্ঠের বিবাহই বা হিন্দু হইয়া কিরূপে প্রদান করিতে পারেন।
এইরূপ ও অন্যান্য নানা চিন্তায় তিনি একবারে অধীর হইয়া পড়িলেন; কিন্তু আপনার মনের ভাব কাহারও নিকট প্রকাশ না করিয়া, কোন্ উপায় অবলম্বন করিলে, চারিদিক বজায় রাখিতে পারেন, কোন দিকে কোন গোলযোগ না হইয়া, সুশৃঙ্খলার সহিত তাহার মনের অভিলাষ সফল করিতে পারেন, কেবল সেই চিন্তাতেই আপন মন নিযুক্ত করিলেন।
সনাতন অনেকরূপ ভাবিয়া চিন্তিয়া দেখিলেন যে, জুয়াচুরি ভিন্ন কোনরূপেই তিনি সতীন্দ্রনাথের বিবাহ দিতে পারেন না। সুতরাং পুত্রের বিবাহের নিমিত্ত জুয়াচুরি-ব্যবসা অবলম্বন করিতেও তিনি কোন প্রকারেই কুষ্ঠিত হইলেন না। বিশেষতঃ তিনি মনে মনে যেরূপ জুয়াচুরির উপায় স্থির করিলেন, তাহা কাৰ্য্যে পরিণত করিতে পারিলে যে, কেবলমাত্র তিনি তাঁহার দুশ্চরিত্র পুত্র সতীন্দ্রনাথের বিবাহ দিতে পারিবেন, তাহা নহে; সেই সঙ্গে সঙ্গে কন্যাপক্ষীয় লোকের নিকট হইতে তিনি কিছু অর্থও সংগ্রহ করিতে পারিবেন। মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া, এখন হইতে যে কোন ব্যক্তি শচীন্দ্রনাথের বিবাহের প্রস্তাব করিতে তাঁহার নিকট আগমন করিতে লাগিলেন, তাহাদিগের মধ্যে কন্যাকৰ্ত্তার অবস্থা ও বুদ্ধিমত্তার অভাব বিবেচনায় শচীন্দ্রনাথের পরিবর্তে সতীন্দ্রনাথকে দেখাইয়া, তাহারই বিবাহের কথা ঠিক করিতে লাগিলেন।
বিবাহের কথাবার্তা ঠিক করিবার পূর্বে সনাতন যে কন্যাকর্তা দিগকে একটু চালাক-চতুর বিবেচনা করিলেন, বা যাহারা আইন-কানুন অবগত আছেন, এরূপ বুঝিলেন, এবং যে সকল ব্যক্তিকে বড়লোক বলিয়া জানিতে পারিলেন, তাহা দিগের নিকট তাহার স্থিরীকৃত জুয়াচুরি-সংশ্লিষ্ট বিবাহের প্রস্তাব করিতে সাহসী হইলেন না। যে মধ্যবিত্ত লোকদিগকে নিতান্ত নিরীহ বলিয়া তাহার বিশ্বাস হইল, তাহাদিগের সহিতই সেই জুয়াচুরি-বিবাহের কথাবার্তা ঠিক করিতে প্রবৃত্ত হইলেন।
সনাতন মনে মনে যেরূপ ভাবিতেছিলেন, কার্যেও ঠিক সেইরূপ জুটিয়া গেল। একদিবস তিনি আপন বাড়ীতে বসিয়া আছেন, এরূপ সময় একটী লোক আসিয়া তাহার বাড়ীতে উপ স্থিত হইলেন। সনাতনকে দেখিয়া তিনি কহিলেন, মহাশয়! আপনার একটী পুত্র এবার ষ্টুডেন্টশিপ পরীক্ষায় পাস হইয়াছে, একথা কি প্রকৃত?
সনাতন। হাঁ। কেন মহাশয়!!
আগন্তুক। আপনি নাকি তাহার বিবাহের নিমিত্ত চেষ্টা করিতেছেন?
সনাতন। হাঁ, অনেকেই তাহার বিবাহের নিমিত্ত আমার নিকট আসিতেছেন।
আগন্তুক। আপনার সেই পুত্রের নাম কি?
সনাতন। শচীন্দ্রনাথ।
আগন্তুক। আপনি বলিলেন, শচীন্দ্রনাথের বিবাহের নিমিত্ত অনেকেই আপনার নিকট আগমন করিতেছেন; কিন্তু তাহার বিবাহের স্থির হইতেছে না কেন?
সনাতন। আমি মনোমত কন্যা পাইতেছি না বলিয়া, এ পর্যন্ত বিবাহের ঠিক হয় নাই।
আগন্তুক। আপনি কিরূপ কন্যা চাহেন? সনাতন। কন্যাটী বড় চাহি, এবং বেশ সুশ্রী চাহি।
আগন্তুক। পুত্রবধূ করিতে সুশ্রী কন্যা পিতা মাত্রই অনু সন্ধান করিয়া থাকেন; কিন্তু বড় কন্যা চাহিতেছেন কেন?
সনাতন। আমার পুত্রটীর বয়ঃক্রম একটু অধিক হইয়াছে, তাহাতেই একটী বড়গোছের বালিকার অনুসন্ধান করিতেছি। নতুবা মানাইবে কেন?
আগন্তুক। আপনার পুত্রটীর বয়ঃক্রম কত হইয়াছে?
সনাতন। পঁচিশ বৎসর।
আগন্তুক। এ অধিক বয়স কি? আপনি কত বড় বালিকা চাহেন?
সনাতন। হিন্দুর ঘরে যত বড় সেয়ানা কন্যা থাকিতে পারে।
আগন্তুক। বার বৎসরের অধিক বয়স্কা কন্যা হিন্দুর ঘরে কখনই আপনি পাইবেন না।
সনাতন। বার বৎসর হইলেই যথেষ্ট হইল; কিন্তু কন্যাটা বেশ সুশ্রী হওয়া আবশ্যক। কেন মহাশয়! আপনি এত কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছেন?