উত্তরে পাত্রের পিতা কহিলেন, ক্ষমা! তাহা আমার দ্বারা কখনই হইবে না। আমার প্রাপ্য টাকাগুলি এখন আপনি আমাকে প্রদান করুন, তাহা হইলে আমি আপনাকে ক্ষমা করিতে পারি। নতুবা কখনই আমি আপনাকে ক্ষমা করি না।
রামরতন। আমি ত আপনাকে পূর্বেই বলিয়াছি যে, আর একটা মাত্র পয়সাও আমি আপনাকে প্রদান করিতে পারি না। ইহাতে চাই আপনি আমাকে ক্ষমা করুন, আর নাই করুন।
উত্তরে বৈবাহিক পুনরায় কহিলেন, ক্ষমা ত কিছুতেই আম। হইতে হইবে না। আমার প্রাপ্য টাকা প্রদান না করিলে আপনার উপর নালিশ করিয়া, আমি আপনাকে কারাগারে প্রেরণ করিব; এবং পরিশেষে আপনার কন্যাকে পরিত্যাগ করিয়া আমার পুত্রের পুনরায় বিবাহ দিব।
আপনার যাহা ইচ্ছা হয়, তাহা আপনি করিতে পারেন। এই বলিয়া রামরতন সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন।
বরের পিতা বড় মানুষ হইলেও, অর্থ-লালসা তাঁহার অতিশয় বলবতী। সুতরাং তিনি সেই অর্থের আশা একবারে পরিত্যাগ করিতে পারিলেন না। মুখে যাহা বলিয়াছিলেন, কার্যেও তাহাই করিলেন। রামরতন বাবু তাহাকে প্রতারণা করিয়াছেন বলিয়া, তিনি তাহার নামে এক ফৌজদারী মোকদ্দমা আরম্ভ করিলেন। রামরতন বাবু কন্যার বিবাহের নিমিত্ত একে ত জুয়াচুরি করিয়া ছিলেন; যখন দেখিলেন, তাহার বিপক্ষে ফৌজদারী মোকদ্দমা উপস্থিত করা হইয়াছে, তখন তিনি মিথ্যা বলিতে আরম্ভ করিলেন। মাজিষ্ট্রেট সাহেবের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া তিনি কহিলেন, ধর্মাবতার! আমি আমার যথা-সৰ্বস্ব বিক্রয় করিয়া স্বর্ণ-অলঙ্কার প্রভৃতি যাহা কিছু আমার দিবার কথা ছিল, তাহা আমি সমস্তই প্ৰদান করিয়াছি। বিবাহের পর দিবস আমার বাড়ী হইতে আমার কন্যাকে লইয়া যাইবার পূর্বে, আমার বৈবাহিক মহাশয় আমার প্রদত্ত সমস্ত অলঙ্কার গুলি উত্তম রূপে স্বচক্ষে দেখিয়া লন; কিন্তু তাহাতেও সন্তুষ্ট না হইয়া পরিশেষে একজন স্বর্ণকারকে ডাকাইয়া সকলের সম্মুখে গহনাগুলি ওজন ও যাচাই করিয়া লন। সেই স্বর্ণকার এখন পর্যন্ত বর্তমান আছে। বিশেষতঃ যাহাদিগের সম্মুখে সেই সকল গহনা যাচান হইয়াছিল, তাঁহারাও এখন পর্যন্ত বর্তমান। আবশ্যক হইলে তাঁহারা সকলেই আপনার সম্মুখে উপস্থিত হইয়া সাক্ষ্য প্রদান করিতে প্রস্তুত। মহাশয়! দুঃখের কথা বলিব কি, আমার বৈবাহিক মহাশয় আমার নিকট হইতে আরও কিছু অর্থ প্রার্থনা করেন। সেই অর্থ প্রদানে আমি অসমর্থ হওয়ায়, আমার সহিত উহার মনান্তর উপস্থিত হয়; এবং পরিশেষে আমি আমার মেজাজ ঠিক রাখিতে না পারিয়া, অনেকের সম্মুখে উহাকে গালি প্রদান করি। উহার প্রতিশোধ লইবার মানসে, আজ তিনি আপনার নিকট আমার নামে এই মিথ্যা অভিযোগ আনয়ন করিয়াছেন।
রামরতন বাবু মুখে যাহা কহিলেন, কাৰ্যেও তাহাই করিলেন। আর কিছু অর্থ ব্যয় করিয়া একজন স্বর্ণকার ও অপর কয়েকজন ভদ্রবেশী লোক দিয়া, সেইরূপ ভাবেই সাক্ষ্য প্রদান করাইলেন। মাজিষ্ট্রেট সাহেবও তাহার কথা বিশ্বাস করিয়া তাহাকে অব্যা হতি প্রদান করিলেন। রামরতন হাসিতে হাসিতে আপন গৃহে গমন করিলেন।
রামরতন বাবুর বৈবাহিক মোকদ্দমা হারিয়া নিতান্ত দুঃখিত মনে আপন বাড়ীতে গমন করিলেন, এবং মনে মনে স্থির করি লেন, রামরতন বাবু যদি তাঁহাকে সেই সকল অর্থ প্রদান না করেন, তাহা হইলে তিনি তাহার কন্যাকে আর আনিবেন না; এবং পুনরায় অন্য স্থানে আপনার পুত্রের বিবাহ দিবেন।
মনে মনে এই কথা স্থির করিয়া, একদিবস তিনি তাঁহার মনের ভাব তাহার স্ত্রীর নিকট কহিলেন। কিন্তু বালিকাটী অতিশয় সুরূপা ছিল বলিয়া, তাঁহার স্ত্রী তাহার প্রস্তাবে সম্মত হইলেন না। ক্রমে সেই কথা তাহার পুত্রেরও কর্ণগোচর হইল; পুত্রীও পুনরায় বিবাহ করিতে অসম্মত হইলেন। কাজেই তাহার মনের দুঃখ মনেই রাখিয়া রামরতন বাবুর কন্যাকে পুত্রবধূরূপে গ্রহণ করিতে হইল। এইরূপে কিছুদিবস অতিবাহিত হইলে পর, রামরতন বাবু আপন বৈবাহিকের সহিত কিছুদিবস পর্যন্ত তোমোদ করিয়া চলিতে লাগিলেন। পরিশেষে সকল গোলযোগ মিটিয়া গেল। রামরতন বাবু এইরূপে জুয়াচুরি করিয়া আপন কাৰ্য্য উদ্ধার করিয়া লইয়াছিলেন।
(খ) বরপক্ষের জুয়াচুরি।
সনাতন বাবু দালালী করিয়া চিরকাল আপন জীবিকা নিৰ্বাহ করিয়া আসিয়াছেন। এখন তাহার বয়স একটু অধিক হওয়া-প্রযুক্ত, আর অধিক পরিশ্রম করিতে পারেন না। সুতরাং তাঁহার আয় পূর্ব্ব হইতে অনেক কমিয়া আসিয়াছে। তাহার তিন পুত্র। প্রথমটীর বয়ঃক্রম প্রায় ত্রিশ বৎসর হইবে, তাহার বিবাহ হইয়া গিয়াছে, একটী পুত্র ও জন্মিয়াছে। কোন একটা সওদাগরি আফিসে মাসিক সত্তর টাকা বেতনে তিনি কৰ্ম্ম করিয়া থাকেন। অধিক পরিমাণে লেখাপড়া শিক্ষা করা তাহার ভাগ্যে পটিয়া উঠে নাই। এন্টেন্স পাস করিয়া কিছুদিবস এল-এ, পৰ্য্যন্ত পড়িয়াছিলেন। কিন্তু কোন কারণ বশতঃ লেখাপড়া পরিত্যাগ করিয়া তাহাকে চাকরীতে প্রবৃত্ত হইতে হয়।
সনাতন বাবুর দ্বিতীয় পুত্রের নাম সতীন্দ্রনাথ। তাহার বয়ঃক্রম প্রায় সাতাশ বৎসর। লেখাপড়া কিছুমাত্র শিক্ষা করে নাই। কোন কাষ কৰ্ম্মের চেষ্টা যে করিতে হয়, তাহা তাহার মনে একদিবসের নিমিত্তও কখন উদিত হয় নাই। বাড়ী হইতে কোনরুপে অর্থ সংগ্রহ করিয়া সুরাপান ও বেশ্যালয়ে গমন করাই তাহার জীবনের একমাত্র মুখ্য উদ্দেশ্য। তাহার বিবাহ হয় নাই। সনাতন বাবু তাহার বিবাহের নিমিত্ত অনেক চেষ্টা করিয়া ছিলেন; কিন্তু তাহার চরিত্র দেখিয়া, বা তাহার বিষয় লোক মুখে শুনিয়া এ পর্যন্ত কেহই তাহাকে আপন কন্যা প্রদান করিতে সম্মত হন নাই। সতীন্দ্রের গুণের মধ্যে এই ছিল যে, সে অতিশয় মিষ্টভাষী, সকলের সহিত বেশ মিলিতে পারিত, ও ভদ্ৰ-বাবহারে সকলকে সন্তুষ্ট রাখিতে পারিত।