মোট – ১৫২২৬টাকা
ফর্দখানি হস্তে পাইবামাত্রই রামরতন বাবু একবারে অবাক্। যদি তিনি তাহার যথাসর্বস্ব বিক্রয় করিয়া ফেলেন, তাহা হইলে তিনি উহার অর্ধেক টাকার সংগ্রহ করিতে পারেন, কি না সন্দেহ। কিন্তু এবার রামরতন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এই পাত্রের সহিত তিনি তাহার কন্যার বিবাহ দিবেনই, মনে মনে তাঁহার এই প্রতিজ্ঞা।
রামরতন বাবু সেই ফর্দখানি হস্তে করিয়া পাত্রের পিতাকে কহিলেন, মহাশয়! ফর্দটী কিছু অধিক হইয়াছে। আমি আপনাকে যেরূপ বলিতেছি, সেইরূপ নগদ ও সুবর্ণ আদি প্রদান করিতে সম্মত আছি; ইহাতে যদি আপনি সম্মত হয়েন, দেখুন; নতুবা আমাকে আপনার আশা পরিত্যাগ করিতে হয়।
বরাভরণের নিমিত্ত আপনি যে তিনশত টাকা মূল্যের ঘড়ি চাহিয়াছেন, তাহা আমি প্রদান করিতে সম্মত আছি।
সোণার চেন এক ছড়া তিনশত টাকা মুল্যের, তাহাও দিব।
হীরার আংটী পাঁচশত টাকা মুল্যের তাহাও আমি দিতে প্রস্তুত আছি।
গার্ডচেন এক ছড়া পঁচিশ ভরি ওজনের কমে যদি না হয়, তাহা হইলেও উহা আমাকে প্রদান করিতে হইবে। কিন্তু বেনারসী চেলী আমি প্রদান করিতে পারিব না।
কন্যাভরণের নিমিত্ত সুবর্ণ তিনশত ভরি আমি প্রদান করিতে প্রস্তুত আছি। উহাতে যে যে অলঙ্কার প্রস্তুত করিতে হইবে, তাহা আমাকে স্পষ্ট করিয়া বলিবেন, আমি সেই সকল গহনা প্রস্তুত করিয়া দিব। কেবল সুবর্ণ বা তাহার মূল্য বলিয়া নগদ কোন অর্থ আমি আপনাকে প্রদান করিব না।
রৌপ্য একশত ভরি আমি প্রদান করিব না। চল্লিশ ভরি দিয়া কেবলমাত্র মল প্রস্তুত করিয়া দিব।
পিত্তল-কাসার দানসামগ্রী এক প্রস্থ আমি প্রদান করিব; কিন্তু তাহার মূল্য চল্লিশ পঞ্চাশ টাকার অধিক হইবে না।
চাঁদির বাসন এক প্রস্থ এক হাজার ভরি প্রদান করা আমার পক্ষে অসম্ভব। তবে যদি আপনি একান্তই না ছাড়েন, তাহা হইলে কাজেই আমাকে উহা প্রদান করিতে হইবে।
খাট বিছানা আমি প্রদান করিতে পারিব না। উহা দিবার রীতি আমাদিগের নাই।
নমস্কারী ও ফুলশয্যার নিমিত্ত পাঁচশত টাকা প্রদান করা আমার পক্ষে একবারে অসম্ভব। সেই সকল খরচের নিমিত্ত জোর আমি একশত টাকা প্রদান করিতে পারি।
নগদ যে চারি হাজার এক টাকা চাহিয়াছেন, উহা আমাকে একবারেই ছাড়িয়া দিতে হইবে। নগদ টাকা আমি একবারেই প্রদান করিতে পারিব না। নিতান্ত না ছাড়েন, চারিশত এক টাকা প্রদান করিব।
বরের পিতা দেখিলেন, তিনি যাহা যাহা চাহিয়াছিলেন, রামরতন প্রায় তাহাতেই স্বীকৃত হইলেন, অপরাপর দ্রব্যের মধ্য হইতে কেবল কমাইলেন—একশত টাকা মূল্যের চেলী, রৌপ্য ষাট টাকা, পিত্তল-কাসা পঞ্চাশ টাকা, খাট বিছানা দুইশত টাকা ও নমস্কারী প্রভৃতি চারিশত টাকা, মোট আটশত দশ টাকা। কিন্তু নগদ টাকা প্রায় দিতে চাহিতেছেন না। অপরাপর দ্রব্যের নিমিত্ত তিনি একরূপ সম্মত হইলেন। কিন্তু নগদ টাকা একবারে পরিত্যাগ করিতে কিছুতেই সম্মত হইলেন না। অনেক কসা-মাজার পর চারি হাজার এক টাকার পরিবর্তে এক হাজার পাঁচশত এক টাকায় তিনি সম্মত হইলেন।
দেনা-পাওনার বিষয় স্থির হইয়া গেলে, কত ওজনের কি কি অলঙ্কার প্রস্তুত করিতে হইবে, রামরতন তাহার একটী তালিকা লইয়া আপন স্থানে প্রস্থান করিলেন। বিবাহের দিন স্থির হইল। উভয়পক্ষেই বিবাহের উদ্যোগ আরম্ভ হইল। রামরতন অলঙ্কার-পত্ৰ সকলের বন্দোবস্ত করিতে লাগিলেন।
যাহার এত টাকার সঙ্গতি নাই, তিনি কিরূপে এই সকল অলঙ্কার-পত্রের সংগ্রহ করিলেন, তাহা কি পাঠকগণ অবগত হইতে চাহেন?
সোণার ঘড়ির পরিবর্তে চল্লিশ টাকা মূল্যের একটী রৌপ্য ঘড়ি ক্রয় করিয়া তাহাতে সুবর্ণের গিটি করিয়া লইলেন। চেন, গার্ডচেন, অলঙ্কার প্রভৃতি যাহা যাহ, সুবর্ণের দ্রব্য দেওয়ার কথা ছিল, তাহার সমস্তই পিত্তলের ক্রয় করিয়া, তাহা ভাল করিয়া সোণার গিলটি করাইলেন। হীরার আংটীর পরিবর্তে একটী উৎকৃষ্ট পোকরাজের বা নকল হীরার আংটী ক্রয় করি লেন। রৌপ্যের দানসামগ্রীর বন্দোবস্তও সেইরূপ করিলেন, কম মূল্যে জৰ্ম্মণ সিভারের বাসন সকল প্রস্তুত করিয়া লইলেন। প্রকৃত দ্রব্যের মধ্যে কেবল প্রদান করিলেন, চল্লিশ ভরির মল, চল্লিশ টাকা মুল্যের পিত্তল-কাঁসা, এবং নগদ এক হাজার ছয়শত এক টাকা। পিত্তলের দ্রব্যাদি ক্রয় করিয়া তাহাতে গিটি প্রভৃতি করাইতেও প্রায় তাহার দুইশত টাকা ব্যয়িত হইল। ইহার উপর বরযাত্রীদিগকে আহার-আদি করাইতে তাহার যে টাকা ব্যয়িত হইল, তাহার সৰ্ব্বশুদ্ধ হিসাব করিলে, একুশ শত কি বাইশ শত টাকার মধ্যেই তাহার সমস্ত খরচ সম্পন্ন হইয়া গেল।
দেখিতে দেখিতে শুভ কাৰ্য্য সম্পন্ন হইয়া গেল। বিবাহের পর নববধূ লইয়া বরের পিতা আপন স্থানে গমন করিলেন। ক্রমে তাঁহার সাধ্যমত পাকস্পর্শ প্রভৃতি কাৰ্য্য সকলও শেষ হইয়া গেল। এই সকল কাৰ্য শেষ হইয়া যাইবার প্রায় একমাস পরে বরের পিতা জানিতে পারিলেন যে, রামরতন বাবু তাহাকে সম্পূর্ণরূপে ঠকাইয়াছেন। এই ব্যাপার জানিতে পারিয়াই তিনি ক্রোধে একবারে অধীর হইয়া পড়িলেন, ও রামরতন বাবুকে ডাকাইয়া তাঁহাকে কহিলেন, এরূপ ভাবে আমাকে প্রতারণা করা কি আপনার কর্তব্য হইয়াছে? উত্তরে রামরতন বাবু কহিলেন, এরূপ প্রতারণা না করিলে, আপনার পুত্রের সহিত আমার কন্যার বিবাহ কি কোনরূপে সম্পন্ন হইতে পারিত? অত টাকা আমি কোথায় পাইব যে, কন্যার সহিত অত টাকা আমি আপনাকে প্রদান করিতে পারি? আপনার সহিত এরূপ জুয়াচুরি করিয়াও, আমাকে যে টাকা ব্যয় করিতে হইয়াছে, তাহাতেও আমি অপরের নিকট ঋণগ্রস্ত। এখন যাহা হইবার হই আছে, যাহা করিবার করিয়াছি! এখন আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। আমি যে আপনাকে আর একটীমাত্র পয়সাও এখন প্রদান করিতে পারি, সে ক্ষমতা আমার নাই। এখন অনুগ্রহ করিয়া আপনি আমাকে ক্ষমা করুন, এই আমার প্রার্থনা।