দাসীর মনোগত অভিপ্ৰায় বুঝিতে পারিলাম, সে যে আমার উপর অবিশ্বাস করিতেছে, তাহাও জানিতে পারিলাম, আমি যখন তাহার সম্পূর্ণ অপরিচিত, তখন তাহার এরূপ অবিশ্বাস জন্মিতে পারে বিবেচনা করিয়া, পূর্ব হইতেই প্ৰস্তুত ছিলাম। তখনই পকেট হইতে একখানি পত্র বাহির করিয়া বলিলাম, আমার কথায় বিশ্বাস না হয়, এই পত্র লও। শোভন সিং আমাকে এই পত্র দিয়াছেন। যাও, আর বিলম্ব করিও না।
এই বলিয়া পত্ৰখানি দ্বাসীর হন্তে প্ৰদান করিলাম। দাসী উহা গ্ৰহণ করিয়া বলিল, না মহাশয়, আপনাকে আমাদের অবিশ্বাস নাই। তবে কি, এ কাজ খুব গোপনে করাই ভাল। আমি পূর্বে আপনাকে আর কখনও দেখি নাই। সেই জন্যই চিনিতে পারিতেছি না। একজন পরিচিত লোক পাঠান শোভনের উচিত ছিল।
আমি ঈষৎ হাসিয়া বলিলাম, আজ রাত্রেই রূপসীকে কোন গোপনীয় স্থানে সরাইয়া ফেলিতে হইবে। এত তাড়াতাড়ি পরিাচিত বিশ্বাসী লোক কোথায় পাইবেন? আমি যদিও তোমাদের পরিচিত নই বটে কিন্তু শোভন সিং আমাকে বাল্যকাল হইতেই চেনে। আমার মত বিশ্বাসী লোক এত শীঘ্ৰ পাইবেন না বলিয়াই কোন পরিচিত লোককে পাঠাইতে পারেন নাই। সে যাহা হউক, তুমি পত্রখানি ভিতরে লইয়া যাও, ও শোভন সিংএর ভগ্নীর হস্তে প্ৰদান কর। তাঁহার পাঠ হইলে তিনি যেরূপ হুকুম দিবেন, সেই–মত কাৰ্য্য করিব।
দাসী হাসিয়া বলিল, পাঠ করিবেন কেমন করিয়া—তিনি লেখাপড়া জানেন না।
আ। তা আমি জানি। কিন্তু শোভন বলিলেন,–তাঁহার ভগ্নীর চাকর পড়াশুনা জানে এবং সেই তাঁহার ভগ্নীপতির অবৰ্ত্তমানে এ বাড়ীর অনেক চিঠি পত্ৰ পড়িয়া থাকে।
দা। সে চাকরিটা ত তাঁহাদের বাড়ীতেই আছে।
আমি বিষম ফাঁপরে পড়িলাম। মনে হইল, এইবার বুঝি বা ধরা পড়িলাম। কিন্তু ঈশ্বরের ইচ্ছায় সে যাত্রা পরিত্রাণ পাইলাম। তখনই আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া বলিলাম, সে কি! শোভন সিং যে আমার সাক্ষাতে তাহাকে এখানে আসিতে বলিলেন। সে কি এখনও সেখান হইতে ফিরিয়া আইছে নাই?
দা। কই, এখনও ত আসে নাই।
আ। শীঘ্রই আসিবে বটে কিন্তু আমি ত ততক্ষণ বিলম্ব করিতে পারিব না। কে জানে, হয় তা ইহার মধ্যেই পুলিসের লোক এখানে অসিতে পারে।
দ। এখানে আসিলে কিছু করিতে পরিবে না, তবে যদি—
দাসী আর কোন কথা বলিতে সাহস করিল না দেখিয়া আমি বলিলাম, তবে যদি কি? আমার নিকট কোন কথা বলিতে ভয় করিও না। আমার দ্বারা উপকার ভিন্ন কোন প্ৰকার অপকারের সম্ভাবনা নাই।
দাসী বলিল, আপনাকে কোন অবিশ্বাস নাই, আপনাকে সকল কথাই বলিতে পারি, কিন্তু কি জানি, যদি আর কোন লোক আমাদের এ সকল কথা শোনে, সেই জন্যই সাবধান হইতেছি।
আ। এখানে আপাততঃ আর কোন লোক নাই, তুমি স্বচ্ছন্দে সকল কথাই বলিতে পার। এখন কি বলিতেছিলে বল?
দা। বলছিলাম, যদি রূপসী কোন প্রকার চীৎকার করিয়া পাঁচজনকে জানাইয়া দেয়, তাহা হইলেই সৰ্ব্বনাশ! মেয়েটা বড় দুষ্টু।
আ। কেন?
দা। সে না কি সেই বুড়োকে বিবাহ করতে পাগল হয়েছে।
আ। বুড়ো কে?
দা। কেন—যার সঙ্গে তার বিয়ের কথা।
আ। সে বুড়ো না কি? আমি ত একবার মাত্র তাকে দেখেছিলাম।
দা। দেখতে বুড়ো না হলেও তার বয়স হয়েছে। তাহার প্রথম পক্ষের ছেলেটী থাকলে এতদিন দশ বছরের হত। যার ছেলের বয়স দশ বছর, তার আবার বিয়ে করা কেন?
আ। তাঁহার ছেলেটী এখন কোথায়?
দা। মারা গেছে।
আ। রূপসীয় তবে এ বিবাহে অমত নাই?
দা। না—এত বয়স হ’লো, এখনও বিয়ে হয় না—বাপের চেষ্টাও নাই। কাজেই এখন যার তার সঙ্গে বিয়ে হ’লেই হ’ল।
আন্তরিক সন্তুষ্ট হইয়া আমি বলিলাম, সে কথা পরে হইবে, এখন রূপসীকে নিয়ে এস। আমি তাকে এখান থেকে নিয়ে যাব। আজই কোন দূরদেশে রওনা না হইলে শোভনের রক্ষা নাই। শুনিয়াছি, সে ভাবী জামাইয়ের নিকট হইতে আট শত টাকা আদায় করিয়াছে।
দাসী আর দ্বিরুক্তি না করিয়া বাড়ীর ভিতর গেল এবং কিছুক্ষণ পরে রূপসীকে লইয়া পুনরায় সেখানে ফিরিয়া আসিল।
পূৰ্বে আমি রূপসীকে দেখি নাই। মনে করিয়াছিলাম, সে বালিকা মাত্র। কিন্তু এখন যাহা দেখিলাম, তাহাতে স্তম্ভিত হইলাম। রূপসীর বয়স প্ৰায় পনের বৎসর বলিয়া বোধ হইল। তাহার শরীরে যৌবনের সমস্ত চিহ্নগুলি পরিস্ফুট হইয়াছে। সে আমার মুখের দিকে সাহস করিয়া চাহিতে পারিল না।
রূপসী সুন্দরী ও যুবতী। তাহার জন্য লাল সিং যে অনায়াসে আটশত টাকা দিবে তাহাতে আর আশ্চর্য্য কি?
দাসীর সহিত রূপসীকে দেখিয়া আমি বলিলাম, মা! তোমার বাপের ইচ্ছা নয় যে, তুমি আর এখানে থাক। তোমাকে এখনই আমার সঙ্গে যাইতে হইবে।
ভিতর হইতে আর একজন রমণী উত্তর করিলেন, দাদার যেমন বুদ্ধি। আমাদের এখানে থাকিলে কোন প্ৰকার গোলযোগের সম্ভাবনা নাই। কেন তিনি রূপসীকে এখন হইতে সরাইতেছেন বলিতে পারি না। যাহাই হউক, দাদার কথামত রূপসীকে আপনার সঙ্গে পাঠাইলাম। দেখিবেন, যেন কোন প্রকার বিপদে পড়িতে না হয়।
আমিও উদ্দেশে উত্তর করিলাম, আপনি সে ভয় করিবেন না। বিশেষ না জানিয়া শুনিয়া শোভন সিং আমার উপর এ কার্য্যের ভার দেন নাই, বরং রূপসী এখানে থাকিলে আপনাদের বিপদের সম্ভাবনা হইতে পারে, আমার সহিত যাইলে সেরূপ কোন ভয়ের কারণ নাই। আপনি পত্রখানি রাখিয়া দিন। উহাতে আমার নাম ধাম সমস্তই আছে। প্রয়োজন হইলে আমায় সংবাদ দিতে পারিবেন। তবে এই পর্য্যন্ত জানিয়া রাখুন যে, আমি আজই রাত্রি সাড়ে দশটার সময় কলিকাতা ত্যাগ করিব।