কিন্তু কেমন করিয়া তাঁহাকে নির্দ্দোষী বলিয়া প্রমাণ করিব। শেষে প্রমাণাভাবে কি একজন নিরপরাধ ব্রাহ্মণ-সন্তানকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলাইয়া দিব। কামিনী নিশ্চয়ই মিথ্যা বলিতেছে। সে যখন শোভন সিংএর রক্ষিতা বেশ্যা ছিল, সে যখন এক-সময়ে শোভন সিংএর পয়সা খাইয়াছে, তখন সে কখনো শোভন সিংএর অনিষ্ট করিতে পারে না। রূপসী শোভনের কন্যা—বাল্যকালে সে যে কামিনীর বাড়ীতে যাইত, তাহা স্পষ্টই জানা যায়। সুতরাং কামিনী যে রূপসীকে ভালবাসিবে, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। সে যে রূপসীকে চুরি করিবে, বিশেষতঃ একজন সামান্য সন্ন্যাসীর কথায় রূপসীকে হত্যা করিবার জন্য তাহার হন্তে অৰ্পণ করিবে, ইহা সম্পূর্ণ অসম্ভব। রমণীর প্রতিহিংসা–বৃত্তি ভয়ানক প্রবল। রমণী যদি কাহারও উপর রাগান্বিত হয়, তাহা হইলে সে যে কোন রূপেই হউক, যতদিন পরেই হউক, তাহার উপায় প্ৰতিশোধ লইবেই লইবে। কিন্তু কামিনীর কোন কারণ ঘটে নাই। লাল সিংএর মুখে শুনিলাম কামিনী এখনও শোভনের নিকট হইতে কিছু কিছু পাইয়া থাকে।
এইরূপ চিন্তা করিতে করিতে হঠাৎ একটা উপায় মনে পড়িল। লাল সিং তখনও থানায় ছিলেন। আমি তাহাকে নিকটে ডাকিলাম। তিনি আসিলে জিজ্ঞাসা করিলাম, শোভনের ভগ্নী ছাড়া ছাড়া আর কোন আত্মীয় আছে কি না? কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া লাল সিং উত্তর করিলেন,–আজ্ঞে না—শোভনের দুইটী ভগ্নী ছিল। একটী ছোট বেলায় মারা পড়ে, অপরটী এখনও বিদ্যমান।
আ। শোভনের এই ভগ্নীর স্বভাব কেমন?
লা। অতি কুৎসিত। তাহার মত খল আর নাই বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। সেই ভগ্নীই যত অনিষ্টের মূল। শোভনের ইচ্ছা থাকিলেও কেবল ঐ ভগ্নীর কথায় সে রূপসীর সহিত আমার বিবাহ দিতে নারাজ ছিলেন।
আ। ভগ্নীর পুত্ৰাদি আছে?
লা। একটী কন্যা ছাড়া আর কোন সন্তান হয় নাই।
আ। বাড়ী কোথায়?
লা। সিয়ালদহের নিকট, আমি সে বাড়ী জানি।
আ। শোভনের ভগ্নী ত এখন তাঁহারই বাড়ীতে আছেন। শুনিয়াছি, রূপসীর বিবাহ উপলক্ষে তিনি ভ্রাতার বাড়ীতে গিয়াছিলেন, সম্ভবতঃ এখনও ফিরিয়া আইসেন নাই।
লাল সিং আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া বলিলেন,–কে বলিল, শোভনের ভগ্নী তাঁহারই বাড়ীতে আছে? আমার বিশ্বাস, তিনি বিবাহের দিন প্ৰাতেই নিজ বাড়ীতে গিয়াছেন।
আমিও বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম,–সে কি! রাত্রে ভাইঝির বিবাহ–আর প্রাতে তিনি নিজ বাড়ীতে ফিরিয়া গেলেন? এ কি নূতন রহস্যের কথা বলিতেছেন?
লা। আজ্ঞে—রহস্যই বটে। তিনি রূপসীর বিবাহ দেখিতে আসিলেন—অথচ বিবাহের দিন প্ৰাতেই নিজ বাড়ীতে ফিরিয়া গেলেন কেন? তাহা বুঝিতে পারিলাম না।
আ। শোভন সিংএর মুখে ত সে কথা শুনিলাম না। তাঁহার ভগ্নী যে সেইদিন প্রাতেই নিজ বাড়ীতে গিয়াছেন, এ কথা ত তিনি বলিলেন না। বরং এমন কথা বলিয়াছিলেন, যাহাতে আমি বুঝিয়াছিলাম যে, তিনি তখনও সেই বাড়ীতে বাস করিতেছেন, এমন কি, তিনি তাহার ভগ্নীপতিকে পৰ্যন্ত দেখাইয়াছিলেন।
লা। তাঁহার ভগ্নীপতি এখনও আছেন বটে কিন্তু ভগ্নী নাই।
আ। কেন তিনি নিজ বাড়ীতে গিয়াছেন, বলিতে পারেন?
লা। আজ্ঞে না। সে কথা বলিতে পরিলাম না।
কিছুক্ষণ চিন্তার পর আমি লাল সিংকে বলিলাম,–আপনাকে এখন একটা কাজ করিতে হইবে। আমি একবার শোভনের ভগ্নীর বাড়ী যাইতে চাই। আপনাকে দূর হইতে বাড়ীখানি দেখাইয়া দিতে হইবে।
লাল সিং সন্মত হইলেন। আমি পুনরায় ছদ্মবেশ পরিধান করিয়া লাল সিংএর সঙ্গে সঙ্গে সিয়ালদহ অভিমুখে গমন করিলাম। রাত্রি আটটার পর লাল সিং একখানি বাড়ী দেখাইয়া দিলেন। আমি তাহাকে থানায় ফিরিয়া যাইতে আদেশ করিয়া অতি ধীরে ধীরে সেই বাড়ীর ভিতরে প্রবেশ করিলাম।
বাড়ীখানি ক্ষুদ্র হইলেও দ্বিতল। বহির্ব্বাটী বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। সদর দরজা পার হইয়া উভয়দিকে দুইটী ঘর দেখিতে পাইলাম। কিন্তু দুইখানি ঘরের দরজাতেই চাবি দেওয়া।
সদর দরজা অতিক্রম করিয়া কিছুদূর গমন ক্রইবার পর আর একটী দরজা দেখিতে পাইলাম। কিন্তু সেটীর ভিতর দিক হইতে আবদ্ধ। ভিতরে প্রবেশ করিতে না পারিয়া আমি সেই দরজার নিকটে দাঁড়াইয়া কড়া নাড়িতে লাগিলাম।
অনেকক্ষণ কেহ কোন সাড়া দিল না, আমি প্ৰায় অৰ্দ্ধঘণ্টা ধরিয়া সেই কড়া নাড়িতে লাগিলাম। অবশেষে বিরক্ত হইয়া চীৎকার করিলাম। কিছুক্ষণ এই প্রকার চীৎকার করিবার পর ভিতর হইতে একজন স্ত্রীলোক উত্তর দিল, কে গো, দরজা যে ভেঙ্গে গেল।
আমার বড় রাগ হইল। আমি বলিলাম, সে কি আমার দোষ—এক ঘণ্টা ডাকাডাকি করেও সাড়া পাই নাই কেন?
আমার কথা শেষ হইতে না হইতে দরজাটী ভিতর হইতে খুলিয়া গেল। একটা বুড়ী দাসী একটা আলোক হস্তে লইয়া আমার দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আপনি কি চান?
কোন প্ৰকার গৌরচন্দ্ৰিক না করিয়া আমি একেবারে বলিয়া উঠিলাম, রূপসীকে শীঘ্ৰ আমার কাছে এনে দাও। এখানে রাখা ঠিক নয়, পুলিসের লোকে জানতে পারলে বাড়ী শুদ্ধ সকলকে এখনই বেঁধে নিয়ে যাবে। শুনেছি তিনজন সন্ন্যাসী গ্রেপ্তার হয়েছে। যতদিন না বিচার হয়, ততদিন রূপসীকে সাবধানে রাখতে হবে।
আমার কথা শুনিয়া দাসী আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল, কোন উত্তর করিল না। রূপালী আছে, কি না, সে বিষয়েও কোন কথা বলিল না। তাহার মুখের ভাব দেখিয়া বোধ হইল, রূপসী সেখানেই আছে, কিন্তু সে কথা সাহস করিয়া বলিতে পারিতেছে না। আমি নিশ্চয় জানিতাম না যে, রূপসী সেখানেই আছে, আন্দাজ করিয়াছিলাম মাত্র। বিশেষতঃ যখন লাল সিংএর মুখে শুনিলাম যে, বিবাহের দিন প্রাতে শোভন সিংএর ভগ্নী তাহার বাড়ীতে প্রস্থান করিয়াছেন, তখন তিনি রূপসীকে লইয়াই আসিয়াছিলেন, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ ছিল না। সেই জন্যই আমি রূপসী সেখানে আছে কিনা, জিজ্ঞাসা না করিয়া তাহাকে আমার নিকট অনিয়া দিবার কথা বলিলাম।