কামিনী চমকিয়া উঠিল। অনেক কষ্টে আত্ম সম্বরণ করিয়া চীৎকার করতঃ বলিল, কি বলছে বাবা! আমি কানে একটু কম শুনি বাবা!
আমি চীৎকার করিয়া পূনর্ব্বার ঐ কথা বলিলাম। এবার সে তখনই কাঁদকাঁদ সুরে উত্তর করিল, কোন ভালখাকি আমার নামে লাগিয়েছে? তার সর্বনাশ হ’ক।
অনেক কষ্টে হাস্য সম্বরণ করিয়া আমি বলিলাম আমি স্বচক্ষে দেখেছি! কেহই আমাকে তোমার নামে কোন কথা বলে নাই। কেন বৃথা গালাগালি দিতেছ বাছা!
কামিনী আমার কথায় যেন সিহরিয়া উঠিল। কিন্তু সেবারও আত্ম সম্বরণ করিয়া হাসিতে হাসিতে আমার দিকে চাহিয়া বলিল, ও সকল কথা নিয়া কি তামাসা ভাল দেখায়? তুমি না হয় ভাল মানুষের ছেলে, কোন কথা বলিবে না, কিন্তু কথায় কথায় পাঁচ কাণ হইলে ত সৰ্ব্বনাশ! কার মনে কি আছে কেমন করিয়া জানিব। ও সকল কথা ছেড়ে দাও—এখন যে জন্য ডেকেছ বল?
আমি কমিনীকে নিকটে ডাকিয়া চুপি চুপি বলিলাম, আমাকে বড় সহজ লোক মনে করো না। আমাকে এখনো কি চিনতে পার নাই? যদি বাঁচবার ইচ্ছা থাকে, সকল কথা প্ৰকাশ কর। তা না হলে তোমাকে জেলে দিব। মেয়েমানুষ বলে ছেড়ে দিব না।
কামিনীর মুখ শুকাইয়া গেল। ভয়ে তাহার সর্বশরীর কাঁপিতে লাগিল, কিছুক্ষণ তাহার মুখ দিয়া কোন কথা বাহির হইল না। তাহার মাথা ঘুরিতে লাগিল। সে আর দাঁড়াইতে না পারিয়া আমার পদতলে বসিয়া পড়িল।
আমি তখন বলিলাম, যখন কাজটা করেছিলে, তখন কি এ সকল কথা ভেবেছিলে? জান না কি, ইংরেজ রাজত্বে দোষ করিলে শাস্তি পাইতেই হইবে, কিছুতেই নিষ্কৃতি পাইবে না।
আমার কথায় কামিনী কাঁদিয়া উঠিল। পরে হাত জোড় করিয়া বলিল, দোহাই বাবা! আমার বেশী দোষ নয় বাবা। পেটের দায়ে একটা হতভাগা সন্ন্যাসীর কথায় আমি মেয়ে দুটীকে তার কাছে নিয়ে গিয়েছিলুম। কে জানে এমন হবে?
আমি ধমক দিয়া বলিলাম, এখন কান্না রাখ, আমি যাহা বলি, তাহার উত্তর দাও। দুটী বালিকাকে নিয়ে গিয়েছিলে বটে, কিন্তু একটী ত ফিরে এসেছে। অপরটা কি হ’লো?
কা। কেমন করে বলি? আমি মেয়ে দুটীকে তার কাছে দিয়ে চলে এসেছিলেম।
আ। কত টাকা পেয়েছিলে?
কা। দশ টাকা।
আ। কে দিল?
কা। সন্ন্যাসী।
আ। তাহাকে চিনতে পারবে?
কা। দেখলেই চিনতে পারবো।
আ। সকল কথা গোড়া থেকে খুলে বল। কিন্তু সাবধান, মিথা বলিও না। যদি জানিতে পারি যে, মিছা বলছে, তাহলেই তোমায় জেল দিব।
কা। না বাবা, আমি মিছা বলবো না। সন্ন্যাসীর কথায় রাজী হয়ে আমি মেয়ে দুটিকে ধরিবার চেষ্টা করি। দুই দিন তাদের বাড়ীর কাছে কাছে ঘুরেও ধরতে পারি নাই। শেষে একদিন ভোরে দুজনে মিলে বাড়ী থেকে বাহির হয়। আমি পাছু নিই। যখন তাহারা পদ্মপুকুরের ধারে গেল, তখন আমি কৌশলে আরক মিশান দুটী জবাফুল তাদের নাকের কাছে ধরি। ফুলের গন্ধে তারা এক রকম পাগল হয়ে যায়। আমি যা বলি, তারাও তাই করে। এই সুবিধা পেয়ে দ্বিরুক্তি না করে, আমি তাহাদিগকে এক গাড়ীতে করে সন্ন্যাসীর কাছে নিয়ে যাই। তার পর সন্ন্যাসীর নিকট থেকে টাকা নিয়ে ঘরে ফিরে আসি। মেয়ে দুটীর কি হলো জানি না।
আ। দুটি মেয়েকেই কি ধরিবার কথা ছিল?
কা। না—কেবল একজনকে। কিন্তু যখন দুজনে এক সঙ্গে ছিল, তখন দুজনকেই ধরে নিয়ে গেলাম।
আ। মেয়ে দুটী সন্ন্যাসীর কি দরকারে লেগেছিল?
কা। জানি না। তবে শুনেছি, সেই সন্ন্যাসী না কি কাপালিক, অনেক নরহত্যা করেছে।
আ। জেনে শুনে তুমি মেয়ে দুটিকে স্বচ্ছন্দে তার হাতে দিলে?
কা। নিজের পেট কাঁদলে জ্ঞান থাকে না।
আ। আচ্ছা—শোভন সিংকে চেন?
কামিনী চমকিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কে শোভন সিং? আমি তাকে চিনি না।
আমি লালসিংএর দিকে চাহিলাম। তিনি আমার অভিপ্ৰায় বুঝিয়া কামিনীর দিকে চাহিয়া বলিলেন, দেখ, কামিনী, ইনি তোমার পূর্ব কথা সমস্তই জানেন। তুমি যে এক সময়ে শোভন সিংএর রক্ষিতা ছিলে, ইনি তাহাও শুনিয়াছেন। এখনঈ মিথ্যা বলিতেছ?
কামিনী আমার মুখের দিকে চাহিয়া কি বলিতে চেষ্টা করিল, কিন্তু পারিল না। আমারও তাহা শুনিবার ইচ্ছা ছিল না। আমি বলিলাম, কামিনীকে এখনই আমার সহিত থানায় যাইতে হইবে।
আমার কথায় কামিনীর ভয় হইল। সে রোদন করিতে লাগিল। আমি মিষ্ট কথায় কামিনীকে সান্ত্বনা করিয়া বলিলাম, তোমার কোন ভয় নাই। যদি দোষ না থাকে, এখনই মুক্তি পাইবে।
কামিনী আমার শ্লেষ বাক্য বুঝিতে পারিল না। আমার কথায় বিশ্বাস করিয়া লালসিং কর্তৃক আনীত একখানি ভাড়াটীয়া গাড়ীতে আমরা সকলেই আরোহণ করিলাম। আড্ডার সকল লোককে পুরষ্কার দিয়া সন্তুষ্ট করত কোচমানকে আমাদের থানায় যাইতে আদেশ করিলাম।
থানায় আসিয়া কামিনী ভজনসিংকে সনাক্ত করিল। সে বলিল, তাঁহারই পরামর্শ মত সে দুই জন বালিকাকে ভুলাইয়া তাঁহার নিকট লইয়া যায়; এবং এই কার্য্যের জন্য সন্ন্যাসী তাহাকে দশটী টাকা দিয়াছেন।
সৌভাগ্যক্রমে সন্ন্যাসীত্রয় তখন ধ্যানে নিমগ্ন—কেহই কামিনীর কথা শুনিতে বা বুঝিতে পারিলেন না।
বালিকাদ্বয়কে ভুলাইয়া লইয়া যাইবার জন্য কামিনীকে গ্রেপ্তার করা হইল। যতদিন না বিচার শেষ হয়, ততদিন তাহাকে হাজতে রাখিবার ব্যবস্থা হইল। কামিনী অনেক কান্নাকাটি করিল, অনেক কাকুতি মিনতি করিল, অনেক গালি বর্ষণ করিল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হইল না।
অষ্টম পরিচ্ছেদ।
পূৰ্বোক্ত পরিচ্ছেদে বর্ণিত কাৰ্য্যগুলি শেষ করিতে সন্ধ্যা হইয়া গেল। আমি নির্জনে বসিয়া এই অদ্ভুত রহস্তের বিষয় চিন্তা করিতে লাগিলাম। ভাবিলাম, তবে কি সত্য সত্যই সন্ন্যাসীগণ রূপসীকে হত্যা করিয়াছে? কামিনী যখন ঐ সন্ন্যাসীকে সনাক্ত করিল, যে ভাবে কামিনী তাহার কথা ব্যক্ত করিল, তাহাতে তাহার কথা মিথ্যা বলা যায় না। অথচ সন্ন্যাসী আমাকে যাহা বলিলেন, তাহাতে তাঁহার কথাতেও অবিশ্বাস হয় না। তবে একজন সাধু সচ্চরিত্ৰ সদাশয় ব্যক্তি, অপর বেশ্যাতিপস্বিনী। কামিনীর কথা মিথ্যা হইতে পারে, কিন্তু সে পুলিসের লোকএর নিকট এমন সাজান কথা বলিয়া পরিত্রাণ পাইবে, তাহা বোধ হয় না। সন্ন্যাসী মিথ্যা বলিবে কেন? সন্ন্যাসীর মৃত্যুরই বা ভয় কি? যাঁহার সংসার-বন্ধন শিথিল হইয়া গিয়াছে, এ জগতে যাঁহার আপন বলিতে কেহ নাই, তিনি সামান্য প্রাণের জন্য, তুচ্ছ জীবনের জন্য পারত্রিক সুখ নষ্ট করিবেন কেন? সন্ন্যাসী নিশ্চয়ই নির্দ্দোষী।