কিরীটী নির্বিকার ভাবে জবাব দিল, খাস গ্লাসে নিয়ে বসে থাকবি।
কি আর করা যায়, চুপ করেই থাকতে হল অগত্যা।
ওয়েটার কিরীটীর নির্দেশমত দুবোতল ঠাণ্ডা বিয়ার ও দুটো গ্লাস এবং একটা প্লেটে কিছু কাজুবাদাম আমাদের টেবিলে রেখে গেল।
ইতিমধ্যে লক্ষ্য করেছিলাম হ্যামিলটন সাহেব গ্লাসের আধাআধি রাম ঢেলে তাতে জল মিশিয়ে বার দুই চুমুক দিয়েই গ্লাসটা প্রায় অর্ধেক করে এনেছে।
কিরীটী দু গ্লাস বিয়ার ঢালল।
নে-না খাস অন্তত মুখের কাছে তোল!
কিরীটীর নির্দেশমত তাই করি।
সময় গড়িয়ে যেতে থাকে। অর্কেস্ট্রা সহযোগ অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সুন্দরী তখন দ্বিতীয় সংগীত শুরু করেছে। হ্যামিলটন ড্রিঙ্ক করে চলেছে। লোকটা যে সুরারসিক বুঝতে দেরি হয় না।
.
ঘড়ির দিকে তাকালাম একসময়, রাত সাড়ে এগারোটা।
হলঘরের ভিড়টা তখন অনেকটা পাতলা হয়ে গিয়েছে বটে, তবু মধুলোভীদের ভিড় একেবারে কমেনি।
সকলের চোখেই নেশার আমেজ। ঘরের মধ্যে তখনও যারা উপস্থিত তাদের তখন যেন নেশা জমাট বেঁধে উঠেছে।
ইতিমধ্যে হ্যামিলটন সাহেব রামের বড় বোতলটি প্রায় নিঃশেষিত করে এনেছে।
এবং সাহেবের যে রীতিমত নেশা ধরেছে সেটা তার দিকে তাকালেই বোঝা যায়।
কিরীটী ফিসফিস করে আমাকে বললে, চল সাহেবের সঙ্গে একটু আলাপ করে আসি।
এতক্ষণ যে এত কষ্ট করে কিরীটী হোটেলে বসে আছে সেও ঐ কারণেই সেটা পুর্বেই বুঝতে পেরেছিলাম।
কিন্তু তবু ইতস্তত করি।
কি হল, ওঠ?
কিন্তু যদি চিনে ফেলে আমাদের!
নেশার ঘোরে আছে, চল্।
চল।
কিরীটীর সঙ্গে নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালাম।
হ্যামিলটন সাহেবের টেবিলে আরও দুটি চেয়ার ছিল। তারই একটা টেনে নিয়ে আমি বসলাম এবং কিরীটী অন্যটায় বসতে বসতে বললে, গুড ইভনিং মিঃ হ্যামিলটন!
নেশায় ঢুলুঢুলু চোখ দুটি খুলে তাকাল আমাদের দিকে হ্যামিলটন সাহেব।
কে? জড়িত কণ্ঠে প্রশ্ন করে হ্যামিলটন।
তুমি আমাকে চিনবে না হ্যামিলটন-আমার নাম রথীন বোস।
আঃ-বোস! বলে নিঃশেষিত গ্লাসটার পাশ থেকে বোতলটা তুলে উপুড় করে ধরল কিন্তু বোতলটায় তখন একবিন্দুও তরল পদার্থ অবশিষ্ট ছিল না।
কিরীটী মৃদু হেসে বলে, ওর মধ্যে তো একবিন্দুও নেই, ঢালছ কি?
নেই! বলে বোতলটা কম্পিত হাতে সামনে তুলে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগল, নেই-ইয়েস, সত্যিই নেই—অল ফিনিশড!
ড়ু ইউ লাইক টু হ্যাভ মোর, মিঃ হ্যামিলটন?
গড ব্লেস ইউ মাই বয়। আই হ্যাভ নট এ ফারদিং লেফট ইন মাই পকেট।
কিরীটী ততক্ষণে ওয়েটারকে ডেকে হ্যামিলটনের শূন্য গ্লাসটার জায়গায় অন্য একটা ভর্তি গ্লাস এনে দিতে বললে।
ওয়েটার এনে দিল নির্দেশমত একটা গ্লাস।
সানন্দে নতুন গ্লাসটা তুলে নিয়ে দীর্ঘ একটা চুমুক দিয়ে জড়িত স্বরে হ্যামিলটন বললে, গড উইল ব্লেস ইউ মাই বয়, গড উইল ব্লেস ইউ। দ্যাট ডার্টি স্নেক, দ্যাট ফিলাদি স্নেক গেভ মি ওনলি ফিফটিন রুপিজ। তাতে কি কিছু হয় মিঃ বোস, তুমিই বল? একজন ভদ্রলোকের এক রাত্রের ড্রিঙ্কের খরচাও হয় না!
তা তো নিশ্চয়ই, কিন্তু তুমি তো ইচ্ছা করলে সীতার কাছ থেকে নিতে পার!
সীতা! ডোন্ট টক অ্যাবাউট হার। জুয়েল, হার্টলেস উয়োম্যান। জান, সে চলে যাবার পর থেকেই তো আমার এই অবস্থা। শি হ্যাজ ফিনিশড মি, শি হ্যাজ ফিনিশড মি। আই অ্যাম গন-গন ফর এভার। কিন্তু তবু-তবু আমি তাকে ভালবাসি।
তুমি তাকে সত্যিই ভালবাস হ্যামিলটন?
সহসা হাত বাড়িয়ে কিরীটীর একটা হাত চেপে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল হ্যামিলটন, হা হা-বাসি—বিশ্বাস কর বোস—দো শি হ্যাজ ডেজার্টেড মি—তবু, তবু তাকে আমি ভালবাসি। আই লাভ হার, আই লাভ হার, আই লাভ হার লাইক এনিথিং। শি ইজ মাই ম্যারেড ওয়াইফ–শি ইজ-কথাটা শেষ হল না হ্যামিলটনের।
অকস্মাৎ আমাদের পিছন থেকে সরু মিহি গলায় কে যেন ডাকল, হ্যামিলটন!
কে? ও চিরঞ্জীব।
আগন্তুক ততক্ষণে বগলের ক্রাচের সাহায্যে আমাদের সামনাসামনি এসে দাঁড়িয়েছে।
বেঁটেখাটো মানুষটা, দৈর্ঘ্যে পাঁচ ফুটের বেশি হবে না।
রোগা লিকলিকে চেহারা।
পরিধানে একটা ঝলঝলে কালো রঙের পুরাতন জীর্ণ স্ল্যাক ও গায়ে অনুরূপ একটা ওপন-ব্রেস্ট কোট।
ভিতরে ময়লা একটা ছিটের শার্ট, তাও গলার বোতামটা খোলা।
মাথায় নিগ্রোদের মত ছোট ছোট চুল–ঘন কুঞ্চিত।
ছড়ানো কপাল, চাপা নাক, দৃঢ়বদ্ধ ওষ্ঠ।
ছোট ছোট কুতকুতে দুটি চক্ষু যেন সতর্ক শিকারী বিড়ালের মত।
ডান পা-টা বোধ হয় পঙ্গু-অসহায়ভাবে ঝুলছে।
এস চিরঞ্জীব, তোমাকে এদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই—মাই বেস্ট ফ্রেন্ড অ্যান্ড ওনলি অ্যাডমায়ারার চিরঞ্জীব কাঞ্জিলাল অ্যান্ড মাই ফ্রেন্ডস বোস–
কিন্তু হ্যামিলটনের আগ্রহে এতটুকু সাড়াও যেন দিল না চিরঞ্জীব।
সে বললে, তুমি এখানে বসে আছ আর তোমার জন্য পকের্টে টাকা নিয়ে আমি তোমাকে সারা দুনিয়ায় খুঁজে বেড়াচ্ছি!
টাকা! আর ইউ রিয়েলি সেয়িং মানি।
ইয়েস–
ও গড ব্লেস ইউ মাই বয়। ইউ ডোন্ট নো হাউ আই অ্যাম ব্যাডলি ইন নিড অফ মানি! দাও দাও-হাত বাড়াল হ্যামিলটন।
সে কি, পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি নাকি? চল, আমার বাড়ি চল।
চল, চল-টলতে টলতে উঠে দাঁড়ায় হ্যামিলটন।
আর একটু হলেই পা বাড়াতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছিল হ্যামিলটন, কিন্তু পলকে হাত বাড়িয়ে পতনোদ্যত হ্যামিলটনকে ধরে চিরঞ্জীব হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল।