বলা বাহুল্য, কারণ ইতিমধ্যে কিরীটীর মনোগত ইচ্ছাটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল।
তা যা বলেছিস। যোগাযোগটা অপূর্ব বলতেই হবে। মৃদুকণ্ঠে জবাব দিলাম আমি।
কিরীটী আমার জবাবে সোৎসাহে বলল, অপূর্ব কিনা জানি না এখনও, তবে অভূতপূর্ব নিশ্চয়ই।
তুই যে সত্যি-সত্যিই নির্মলশিববাবুর স্বর্ণমৃগয়ার অকুস্থলের সন্ধানেই আজ বেরিয়েছিস, সত্যিই কিন্তু আমি প্রথমটায় কল্পনাও করতে পারিনি কিরীটী।
তবে তুই কি ভেবেছিলি, সত্যি-সত্যিই আমি হাওয়া খেতে বের হয়েছি?
না—তা নয়—
তবে?
আচ্ছা তোর কি মনে হয় কিরীটী, ঐ ওভারসিজ লিঙ্কই সত্যি সত্যি নির্মলশিববাবুর স্বর্ণমৃগয়ার অকুস্থল?
ততখানি এত তাড়াতাড়ি ভেবে নেওয়াটা কি একটু কল্পনাধিক্যই মনে হচ্ছে না? না ব্রাদার—no so fast! বঙ্কিমী ভাষায় বলব, ধীরে রজনী, ধীরে।
তা অবশ্যি ঠিক। তবে ঘটনাচক্রে অনেক সময় অনেক অভূতপূর্ব ব্যাপারও ঘটে তো!
তা যে ঘটে না তা আমি অবশ্যি বলছি না, তবে—
তবে?
তবে সীতা মেয়েটি সত্যিই অনিন্দনীয়া। কি বলিস?
হুঁ।
হুঁ কি রে? ভাল লাগল না দেখে তোর মেয়েটিকে? আমার তো মনপ্রাণ এখনও একেবারে ভরে রয়েছে।
সত্যি নাকি?
হুঁ।
আর আর্থার হ্যামিলটন? তার সম্পর্কে তোকই কিছু বললি না!
লোকটা রসিক নিঃসন্দেহে, এইটুকুই বলতে পারি।
কি বললি, রসিক?
নয়? অমন একটি মেয়ের চিত্তহরণ যে একদা করে থাকতে পারে, সে রসিকজন বৈকি। সত্যিই কবি যে বলে গিয়েছেন একদা প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে কথাটা খুব খাঁটি কিন্তু তুই যা বলিস।
তা তোর কিসে মনে হল যে ঐ আর্থার হ্যামিলটন একদা সীতার মনপ্রাণ সত্যি সত্যিই হরণ করেছিল?
কেন, সোজাসুজি এসে একেবারে বললে শুনলি না, ফিরে যাবে কিনা বল?
তার মানে বুঝি—
অতশত জানি না তবে আমার যেন মনে হল ক্ষণপূর্বে সেক্রেটারি সীতার ঘরে বৃত্ররূপী যে দৈত্যের আবির্ভাব ঘটেছিল, সেই বৃত্রই ঐ শচীদেবীকে কোন এক সময় বেচারী ইন্দ্ররূপী দুর্বল আর্থার হ্যামিলটনের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে এসেছে।
তুই বুঝি ঐ কাব্য মনে মনে এতক্ষণ ধরে রচনা করছিলি কিরীটী?
হ্যাঁ, ভাবছিলাম—
কী?
দধীচীর মত নিজ অস্থি দিয়ে ঐ দুর্বল ইন্দ্রকে যদি গিয়ে বলি, লহ অস্থি, কর নির্মাণ বজ্র-সংহার ঐ দৈত্যাসুর বৃত্রকে!
হো হো করে হেসে উঠি আমি।
হাসছিস কিন্তু বেচারীর সে-সময়কার করুণ মুখখানার দিকে ভাল করে তাকিয়ে দেখলে তোরও ঐ কথাই মনে হত।
ইতিমধ্যে মেট্রোর কাছ বরাবর আমরা এসে গিয়েছিলাম।
আগের ট্যাকশিটা সোজা এগিয়ে গিয়ে ডাইনে বাঁক নিল। তারপর কিছু দূরে এগিয়ে বাঁ দিকে ঢুকে পড়ল।
আমাদের ট্যাকশিচালক সর্দারজী ঠিক তাকে অনুসরণ করে যায়।
শেষ পর্যন্ত আগের ট্যাক্সিটা কুখ্যাত চীনাপাড়ার এক অখ্যাত চীনা হোটেলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
বাবুজী, উও আগারি ট্যাকশি তো রুখ গিয়া!
হিঁয়াই রোখো সর্দারজী।
লক্ষ্য করলাম, আগের ট্যাকশি থেকে নেমে আথার হ্যামিলটন সাহেব ট্যাকশির ভাড়া মিটিয়ে দিচ্ছে।
ভাড়া চুকিয়ে দিয়ে হ্যামিলটন হোটেলের ভিতরে গিয়ে প্রবেশ করল।
বলা বাহুল্য আমরাও একটু পরে সেই হোটেলেই গিয়ে প্রবেশ করলাম দুজনে।
.
০৮.
ভিতরে প্রবেশ করে যেন একটু বিস্মিতই হই।
এমন পাড়ায় অখ্যাতনামা একটি চীনা হোটেলে বেশ কসমোপলিটন ভিড়।
হোটেলটায় প্রবেশ করবার মুখে হোটেলের নামটা লক্ষ্য করেছিলাম। বিচিত্র নামটিও।
চায়না টাউন।
বেশি রাত নয়—মাত্র সাড়ে নয়টা তখন।
ভিতরে প্রবেশ করে দেখি, কসমোপলিটন খরিদ্দারের ভিড়ে তখন গমগম করছে হোটেলের হলঘরটি।
এক পাশে ড্রিঙ্কের কাউন্টার। তারই গা ঘেঁষে বাঁয়ে প্যানট্রির দরজা এবং ডাইনে ছোট একটি ডায়াস।
ইংরাজী অর্কেস্ট্রা সহযোগে একটি ক্ষীণাঙ্গী, মনে হল অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মেয়েই হবে, নানাবিধ যৌনাত্মক অঙ্গভঙ্গি সহকারে নাকিসুরে কি একটা দুর্বোধ্য ইংরাজী গান গেয়ে চলেছে।
চারপাশে টেবিল চেয়ারে জোড়ায় জোড়ায় নানাবয়সী পুরুষ ও নারী, কেউ খেতে খেতে, কেউ কেউ আবার ড্রিঙ্ক করতে করতে সেই যৌনরসাশ্রিত সঙ্গীত উপভোগ করছে।
একটা বিশেষ ব্যাপার ঘরে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নজর করছিলাম—উজ্জ্বল আলো নয়-ঈষৎ নীলাভ স্রিয়মাণ আলোয় সমস্ত হলঘরটি স্বল্পালোকিত বলা চলে।
রীতিমত যেন একটা রহস্যনিবিড় পরিবেশ হোটেলটির মধ্যে।
ইতিমধ্যে দক্ষিণ কোণে একটা টেবিলে হলঘরের নিরিবিলিতে হ্যামিলটন সাহেব জায়গা করে বসে গিয়েছে লক্ষ্য করলাম। ..
তারই পাশে আর একটা খালি টেবিল তখনও ছিল, কিরীটী আমাকে নিয়ে সেই দিকেই এগিয়ে চলল।
নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে আমরা টেবিলটার দুটো চেয়ার টেনে নিয়ে বসলাম মুখোমুখি।
হ্যামিলটনের অত কাছাকাছি গিয়ে বসতে আমার যেন ঠিক মন সরছিল না, কিন্তু দেখলাম হ্যামিলটন আমাদের দিকে ফিরেও তাকাল না।
সে অন্যদিকে অন্যমনস্ক ভাবে তখন চেয়ে আছে।
কিন্তু হ্যামিলটনের সঙ্গের সেই দৈত্যাকৃতি লোকটাকে আশেপাশে কোথাও নজরে পড়ল না।
ইতিমধ্যে একজন ওয়েটার দেখলাম একটা পুরো বোতল, একটা গ্লাস ও একটা কাচের জাগভর্তি জল এনে হ্যামিলটন সাহেবের সামনের টেবিলের উপরে নামিয়ে রাখল।
বোয়।
কিরীটীর আহ্বানে সেই লোকটাই আমাদের সামনে এগিয়ে এল।
দুটো কোল্ড বিয়ার।
তাড়াতাড়ি বললাম, আমি তো বিয়ার খাই না!