ডান কপালে দীর্ঘ একটা ক্ষতচিহ্ন।
নাকটা তরোয়ালের মত যেন ধারাল, তীক্ষ্ণ।
পরিধানে একটা জীর্ণ মলিন ক্রি-ভাঙা কালো গরম কোট ও অনুরূপ সাদা ময়লা জিনের প্যান্ট। গলায় লাল বুটি-দেওয়া পুরাতন একটা টাই।
আরও চেয়ে দেখলাম, তরুণীর মুখখানা অসহ্য ক্রোধে আর আক্রোশে যেন সিঁদুরবর্ণ ধারণ করেছে।
আগন্তুক আবার বললে, say–yes or no!
বেয়ারাটাও ইতিমধ্যে আগন্তুকের সঙ্গে সঙ্গেই তার পিছনে ঘরে এসে ঢুকেছিল।
বেচারী মনে হল যেন আকস্মিক ঘটনায় একটু হতভম্ব হয়েই নির্বাক হয়ে গিয়েছে।
সহসা তরুণী সেই হতভম্ব নির্বাক বেয়ারার দিকে তাকিয়ে বললে, এই, হাঁ করে চেয়ে দেখছিস কি? দারোয়ানকে ডাক?
সঙ্গে সঙ্গে খিঁচিয়ে উঠল আগন্তুক যেন, কি, দারোয়ান দেখাচ্ছ! আর্থার হ্যামিলটনকে আজও চেনোনি সুন্দরী। সব ফাঁস করে দেব। সব একেবারে চিচিং ফাঁক করে দেব।
সহসা ঐ সময় পিছনের সুইংডোরটা আবার খুলে গেল এবং স্ল্যাক ও হাফশার্ট পরিহিত বিরাট দৈত্যাকৃতি একজন লোক এসে যেন অকস্মাৎ ঘরের মধ্যে ঢুকল ও বজ্রগম্ভীর কণ্ঠে ডাকল, আর্থার।
সঙ্গে সঙ্গে জোকের মুখ যেন নুন পড়ল।
.
হ্যামিলটন সাহেব সেই ডাকে ফিরে দাঁড়িয়ে আগন্তুকের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ক্ষণপূৰ্ব্বের এত হম্বিতম্বি যেন দপ্ করে নিভে গেল।
মুহূর্তে যাকে বলে একেবারে যেন চুপসে গেল মানুষটা।
ইয়ে–স স্যার–র–
কথাটা বলতে গিয়ে তোতলায় হ্যামিলটন।
কাম অ্যালং! তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।
প্রভুভক্ত কুকুর যেমন প্রভুর ডাকে তাকে অনুসরণ করে, ঠিক তেমনি করেই যেন মাথা নিচু করে নিঃশব্দে সেই দৈত্যাকৃতি আগন্তুকের সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে বের হয় গেল হ্যামিলটন।
দেখলাম সেক্রেটারি দিদিমণি যেন কেমন বিব্রত ও থতমত খেয়ে বসে আছে।
আকস্মিক যে এমনি একটা ব্যাপার ঘটে যাবে, বেচারীর যেন ক্ষণপুর্বে স্বপ্নেরও অগোচর ছিল।
কিরীটী মৃদুকণ্ঠে বললে, তাহলে আমরা আজকের মত আসি!
তরুণী যেন চমকে ওঠে। বলে, অ্যাঁ, যাবেন?
হ্যাঁ! আমরা চলি।
বেশ।
অতঃপর কিরীটীর নিঃশব্দ ইঙ্গিতে কিরীটীর পিছনে পিছনে আমি ঘর থেকে বের হয়ে এলাম।
কিউবিকলের বাইরে এসে এদিক ওদিক তাকালাম, কিন্তু সেই হলঘরের মধ্যে কোথায়ও ক্ষণপূর্বের দৃষ্ট সেই বিচিত্র বেশভূষা পরিহিত আর্থার হ্যামিলটন বা দৈত্যাকৃতি সেই লোকটাকে দেখতে পেলাম না।
শুধু তাই নয়, হলঘরে আগে যাদের কাজ করতে দেখেছিলাম তাদেরও কাউকে। আর দেখতে পেলাম না ঐ সময়।
হলঘরটা তখন শূন্য।
দুজনে বাইরে বের হয়ে এলাম।
.
০৭.
রাস্তায় পড়ে কিরীটীর সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে তখনও ভাবছি, ব্যাপারটা কি হল?
কিরীটীও স্তব্ধ হয়ে হেঁটে চলেছে।
কিন্তু কিরীটী খুব বেশি দূর অগ্রসর হল না।
পনেরো বিশ গজ হেঁটে গিয়ে ঐ ফুটপাতেই একটা পানের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে হিন্দুস্থানী পানওয়ালাকে বলে, বেশ ভাল করে জর্দা কিমাম দিয়ে দুটো পান তৈরি করতে।
পানওয়ালা পান তৈরি করে দিল।
পান নিয়ে দাম মিটিয়ে দিয়ে, পান মুখে পুরে দিয়ে বেশ আরাম করে কিরীটী চিবুতে লাগল সেই দোকানের সামনেই ফুটপাতের উপর দাঁড়িয়ে।
নড়বার নামগন্ধও নেই যেন।
বুঝতে পারি, ঐ সময় পান কেনা ও পান খাওয়া কিরীটীর একটা ছল মাত্র।
কিছু সময় হরণ করতে চায় সে ঐখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিশেষ কোন উদ্দেশ্যেই।
ইতিমধ্যে দেখি দিব্যি পানওয়ালার সঙ্গে এটা-ওটা আলাপ শুরু করে দিয়েছে কিরীটী।
চার প্যাকেট কি এক নতুন ব্র্যাণ্ডের উর্বশী-মার্কা সিগারেটও কিনল, যে সিগারেট কস্মিনকালেও খায় না। এবং সর্বক্ষণ ওর মধ্যেই যে তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এদিক-ওদিকে, বিশেষ করে অদূরবর্তী ওভারসিজ লিঙ্কের অফিসের দিকে নিবন্ধ হচ্ছিল সেটা অবশ্য
আমার নজর এড়ায় না।
প্রায় আধ ঘণ্টা পরে, একটু বোধ হয় অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ কিরীটী হাত ধরে আকর্ষণ করে নিম্নকণ্ঠে বললে, আয় সুব্রত!
কোথায়?
আয় না! বলে আমার হাতটা ছেড়ে দিয়ে এগিয়ে চলল।
বাধ্য হয়েই যেন কিরীটীকে আমি অনুসরণ করি।
কোথায় যাচ্ছি, কি ব্যাপার, কিছুই বুঝতে পারি না।
রাস্তার ধারে ট্যাকশি পার্কে একটা ট্যাকশি দাঁড়িয়ে ছিল, এতক্ষণে নজরে পড়ল কিরীটী সেই দিকেই হনহন করে হেঁটে চলেছে।
সোজা গিয়ে কিরীটী খালি ট্যাকশিটায় উঠে বসল আমাকে নিয়ে।
তারপরেই ট্যাকশি-চালককে চাপাকণ্ঠে বললে, সামনের ঐ ট্যাকশিটাকে ফলো করে চল সর্দারজী।
নজর করে দেখলাম সামনেই অল্পদূরে তখন একটা বেবী ট্যাকশি চৌরঙ্গীর দিকে ছুটে চলেছে।
হাতঘড়ির দিকে চেয়ে দেখলাম রাত নটা বাজে প্রায়।
রাস্তায় তখন নানাবিধ যানবাহনের রীতিমত ভিড়। এবং থিয়েটার রোড পর্যন্ত বেশ সমগতিতে এসে ট্রাফিকের জন্য আগের গাড়ির গতি ও সেই সঙ্গে আমাদের গাড়ির গতিও হ্রাস হয়।
কিরীটী ইতিমধ্যে ট্যাকশির ব্যাকে বেশ আরাম করেই বসেছিল, যদিও তার তীক্ষ্ণ সতর্ক দৃষ্টি বরাবরই নিবদ্ধ ছিল সামনের চলন্ত ট্যাকশির উপরেই।
গাড়ির গতি আর হ্রাস হতে এতক্ষণে কিরীটী মুখ খুলল, সত্যি কথা বলতে কি সুব্রত, একান্ত ঝোঁকের মাথায়ই বাড়ি থেকে সন্ধ্যায় বেরোবার মুহূর্তে কল্পনাও করতে পারিনি এমন একটা সরস রোমাঞ্চকর রাত্রি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।