আমার যে এখন সেই অবস্থা। খ্যাপা খুঁজে খুঁজে ফিরে পরশ পাথর! চল–চল।
আমাকে আর দ্বিতীয় কোন প্রশ্ন বা বাদ-প্রতিবাদের অবকাশমাত্রও না দিয়ে সহসা লম্বা লম্বা পা ফেলে, সত্যি সত্যি দেখি, ও ওভারসিজ লিঙ্কের খোলা দ্বারপথের দিকেই এগিয়ে চলেছে।
অগত্যা অনুসরণ করতেই হল ওকে।
দরজার গোড়াতেই চাপদাড়ি শিখ দারোয়ান রাইফেল হাতে একটা টুলের উপর বসে প্রহরায় নিযুক্ত ছিল।
আমাদের দেখে সেলাম জানিয়ে কাচের স্প্রিংডোর ঠেলে রাস্তা করে দিল।
ঘরে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঠাণ্ডা একটা হাওয়ার ঝাপটা যেন সর্বাঙ্গ জুড়িয়ে দিল।
এয়ার-কনডিশন করা ঘর বুঝলাম। ঘর বলব না, বিরাট একটা হলঘরই বলা উচিত। একধারে কাউন্টার, অন্যদিকে পর পর তিনটি কাঠের পার্টিশন দেওয়া কিউবিকল। দেওয়ালে দেওয়ালে ফ্লরেসেন্ট টিউবের সাদা ধবধবে আলো জ্বলছে।
ঝকঝকে তকতকে পালিশ করা সব চেয়ার টেবিল।
এক কোণে সুসজ্জিত সোফা ইত্যাদি-ভিজিটারদের বসবার স্থান।
মেঝেতে দামী পুরু কার্পেট বিস্তৃত, কিন্তু সমস্ত কক্ষটিতে তখন নজরে পড়ল গুটি দু-তিন লোক মাত্র কাউন্টারের অপরদিকে টেবিলের সামনে বসে কি সব কাগজপত্র নিয়ে কাজ করছে।
একজন উর্দিপরা বেয়ারা এগিয়ে এল, কি চাই?
বড় সাহেব আছেন তোমাদের?
সাহেব তো নেই। সেক্রেটারি দিদিমণি আছেন।
সেক্রেটারি দিদিমণি?
আজ্ঞে।
বেশ, তাকেই বল গিয়ে একজন বাবু জরুরি কাজের জন্য দেখা করতে চান।
বসুন, খবর দিচ্ছি। বেয়ারা চলে গেল।
লক্ষ্য করলাম বেয়ারা অদূরবর্তী একটা কিউবিকলের সুইংডোর ঠেলে ভিতরে গিয়ে ঢুকল।
আমরা সোফায় বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম।
বসে বসে আমি ভাবছি কিরীটীর মতলবখানা কি!
দুম করে এই অফিসে এসে ঢুকল কেন ও, তবে কি ওর ধারণা এই অফিসটাই চোরাই সোনার কারবারের কেন্দ্রস্থল?
কিন্তু যদি ব্যাপারটা সত্যিই হয় তো স্বীকার করতেই হবে, অমন একটা চোরাই কারবার এমন প্রকাশ্য একটা স্থানে বসে জাকজমকসহ করার মধ্যে দুঃসাহসিকতা আছে সন্দেহ নেই।
এবং যারাই ঐ কারবার করুক না কেন তাদের সে দুঃসাহসটা রীতিমতই বুঝি আছে।
যাই হোক একটু পরেই কিন্তু বেয়ারা ফিরে এল।
বললে, চলুন–
বেয়ারার নির্দেশমত আমরা সেক্রেটারি দিদিমণির কিউবিকলের মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করলাম।
এবং প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই সুমিষ্ট নারীকণ্ঠে আহ্বান এল, বসুন!
কণ্ঠস্বর নয়, যেন সুরলহরী।
আর শুধু কি সুরলহরীই, ঐ সঙ্গে রূপ এবং সাজসজ্জায়ও যেন অসামান্যা। এক কথায় সত্যিই অতুলনীয়। এবং সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্য পড়ল সম্মুখে উপবিষ্টা সেই অসামান্যা নারীর চক্ষুর প্রতি।
তীক্ষ্ণ ধারাল ছুরির ফলার মত সে দুটি চক্ষুর দৃষ্টি। যে দৃষ্টি কিরীটীর প্রতি স্থিরনিবদ্ধ। মুহূর্তের স্তব্ধতা। তারপরই প্রসন্ন একটুকরো হাসিতে তরুণীর মুখখানা যেন ভরে গেল।
সে বললে, বসুন।
০৬-১০. বসলাম পাশাপাশি দুজনে দুটি চেয়ারে
বসলাম পাশাপাশি দুজনে দুটি চেয়ারে।
আজও মনে আছে, রূপ অনেক এ পোড়া চোখে পড়ছে কিন্তু রূপের সঙ্গে বুদ্ধির ওরকম খর্য সত্যিই বুঝি আর চোখে পড়েনি।
কিরীটী ফেরার পথে আমার প্রশ্নের উত্তরে সেদিন বলেছিল, তিলোত্তমা!
সত্যিই তিলোত্তমা।
আপনাদের কি করতে পারি বলুন? পুনরায় তরুণী প্রশ্ন করল।
আপনাদের ম্যানেজারের সঙ্গেই আমার দরকার ছিল।
মিঃ মল্লিক তো এখন নেই, আপনি তা হলে কাল দুপুরের দিকে আসুন। তবে কোন অর্ডার-সাপ্লাইয়ের ব্যাপার হলে আমাকে বলতে পারেন।
অবশ্য অর্ডার-সাপ্লাইয়ের ব্যাপারই। তবে—
কি সাপ্লাই করতে হবে?
আমার নিজস্ব একটা ছোটখাটো কেমিকেলের কারখানা আছে। তাই কিছু অর্ডার আমি ফরেন থেকে পেয়েছি। আপনাদের থু দিয়ে সেটা আমি সাপ্লাই করতে চাই।
ও! তা সেরকম কোন সাপ্লাই তো আমরা করি না।
অবশ্যই আপনাদের আমি একটা ওভার-রাইডিং কমিশন দেব।
আপনি বরং কাল এসে ম্যানেজার মিঃ মল্লিকের সঙ্গেই দেখা করবেন।
বেশ, তাই করব। আমাদের কথাটা তাহলে তাকে বলে রাখবেন।
কি নাম বলব। তরুণী প্রশ্ন করে।
কিরীটী কি যেন বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার মুখের কথা মুখেই রয়ে গেল, বাইরে পুরুষকণ্ঠে একটা বচসা শোনা গেল।
আরে রেখে দে তোর সেক্রেটারি দিদিমণি! ঘরে লোক আছে, দেখা করবে না! তার বাপ দেখা করবে, চোদ্দ পুরুষ করবে—হামভি আর্থার হ্যামিলটন হ্যায়!
সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম আমাদের সামনে উপবিষ্টা তরুণীর মুখ থেকে অমায়িক ভাবটা যেন মুহূর্তে নির্বাপিত হয়ে গেল।
.
সমস্ত মুখখানা তো বটেই এবং দেহটাও সেই সঙ্গে যে কঠিন ঋজু হয়ে উঠল।
পাশ থেক একটা প্যাড ও পেনসিল তুলে নিয়েছিল। তরুণী ইতিমধ্যে, বোধ করি কিরীটীর নামটাই টুকে নেবার জন্য, হাতের পেন্সিল হাতেই থেকে গেল।
পরমুহূর্তেই একটা দমকা হাওয়ার বেগে ঘরের সুইংডোর ঠেলে খুলে যে লোকটি ঠিক ভগ্নদূতের মতই ভিতরে এসে প্রবেশ করল সে দর্শনীয় নিঃসন্দেহে।
আমরা যে ঘরের মধ্যে বসে আছি তা যেন ভ্রক্ষেপ করল না।
তীক্ষ্ণকণ্ঠে সামনের চেয়ারে উপবিষ্ট তরুণীকে সম্বোধন করে বললে, আমি জানতে চাই সীতা, তুমি আমার ওখানে ফিরে যাবে কিনা? Say–yes or no?
আগন্তুককে দেখছিলাম আমি তখন।
ঢ্যাঙা লম্বা চেহারা।
একমুখ দাড়ি, ঝোড়ো কাকের মত একমাথা ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল, তৈলহীন রুক্ষ।