অতঃপর চা নয়, যেন চিরতার জল—এইভাবে অতিকষ্টে একটু একটু করে গলাধঃকরণ করলে নির্মলশিব সাহেব।
তারপর নিঃশেষিত চায়ের কাপটা নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল, কি আশ্চর্য! এ। যে দেখছি কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরুল বলে মনে হচ্ছে!
কিরীটী মৃদু হেসে আবার টিপ্পনী কাটল, হ্যাঁ, ঢোঁড়া নয়, জাতসাপ একবারে। তা যাক গে সেকথা, আপনাকে আমি সাহায্য করব নির্মলশিববাবু, তবে এক শর্তে–
শর্তে!
হ্যাঁ আপাতত আপনি ঐ ব্যাপারে আমাকে যে সঙ্গে নিয়েছেন, সেকথা কাউকেই জানাতে পারবেন না।
বেশ।
আপনার কর্তৃপক্ষকেও নয় কিন্তু—
তাই হবে।
সেদিনকার মত নির্মলশিব গাত্রোখান করল।
.
নির্মলশিবের প্রস্থানের পর আধ ঘণ্টা কিরীটী যেন কেমন ধ্যানস্থ হয়ে বসে রইল।
দুটি চক্ষু বোজা।
বুঝলাম কিরীটী নির্মলশিবের ব্যাপারটাই চিন্তা করছে।
অগত্যা আজ আর এসময় এখানে বসে থাকা বৃথা। উঠব উঠব ভাবছি, এমন সময় কিরীটী সহসা চক্ষু মেলে একটা আড়মোড়া ভেঙে বলল, চল্ সুব্রত, একটু সন্ধ্যার হাওয়া খেয়ে আসা যাক পদব্রজে।
জুন মাস। প্রচণ্ড গ্রীষ্মের সময় সেটা।
ইতিমধ্যে সন্ধ্যা হয়ে এলেও বাইরের প্রচণ্ড তাপ যে এখনও অগ্নিবর্ষণ করছে সে সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ আমি।
কিরীটীর এয়ারকন্ডিশন ঘর বরং আরামেই বসে আছি; তাই বললাম, বাইরে এখনও গরম–
চল্ চল, বেশ ফুরফুরে দখিনা হাওয়া বাইরে দেখবি!
সত্যিই-সত্যিই অতঃপর কিরীটী উঠে দাঁড়াল।
কৃষ্ণাও এবারে স্বামীর মুখের দিকে একটু বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে শুধাল, সত্যিই বেরুচ্ছ নাকি?
হ্যাঁ, যাই, অনেকদিন ঘরের বাইরে পা দিইনি—ভবানীপুর অঞ্চলটার মধ্যে নিশ্চয়ই অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বলতে বলতে কিরীটী ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
কিরীটী ঘর থেকে বের হতেই সহাস্যে কৃষ্ণা বললে, ভাগ্যে তুমি দাবা খেলায় আজ ওর কাছে মাত হয়েছিলে ভাই, নচেৎ সত্যি বলছি, গত ছ-সাত মাস ও ঘরের বাইরেই পা দেয়নি–
কিন্তু তাতে করে তো তোমার দুঃখ হওয়া উচিত নয় বৌদি। বরং–
না ভাই, ওকে নিষ্ক্রিয় দেখলে কেমন যেন আমার ভয়-ভয় করে!
ভয় করে নাকি?
হ্যাঁ, সে সময়টা ও যেন কেমন আলাদা মানুষ হয়ে যায়। কেমন অন্যমনস্ক।
হবেই তো, ও হচ্ছে প্রতিভার আত্মকণ্ডুয়ন। প্রতিভা জেনো চিরদিনই এককনিঃসঙ্গ।
আমাদের কথার মধ্যেই কিরীটী প্রস্তুত হয়ে পুনরায় ঘরে এসে ঢুকল। বলল, চল্।
.
০৫.
দুজনে রাস্তায় বের হয়ে হেঁটে চললাম।
সন্ধ্যার অন্ধকার সবে ঘন হয়ে এসেছে, চারিদিকে রাস্তায় ও দোকানে দোকানে আলো জ্বলে উঠতে শুরু করেছে।
কিরীটী কিন্তু মিথ্যা বলেনি।
বাইরে সত্যিই যেন ভারি একটা মিষ্টি হাওয়া ঝিরঝির করে বইছিল।
সারাটা দিনের প্রচণ্ড তাপের দহনের পর ঐ ঝিরঝিরে ঠাণ্ডা হাওয়াটুকু সত্যিই উপভোগ্য।
কিন্তু রাস্তায় বের হয়ে কিরীটী যেন হঠাৎ কেমন বোবা হয়ে যায়।
নিঃশব্দে রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে লক্ষ্য করলাম, কেবল তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে সে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।
অফিসের ছুটির পর ঘরমুখো হাজার হাজার চাকুরেদের রাস্তায় ও ট্রামে-বাসে বাদুড় ঝোলা ভিড় চোখে পড়ে।
হঠাৎ কিরীটী একসময় বলে, শেষ কবে আদমসুমারী হয়েছে রে সুব্রত?
কেন?
না, তাই বলছি। অনেকদিন বোধ হয় জনসংখ্যা গোনা হয় নি!
বুঝলাম মানুষের ভিড়কে লক্ষ্য করেই কিরীটীর ঈদৃশ বক্রোক্তি।
হেসে বললাম, জনসংখ্যা তো বাড়ছেই।
বাড়ছে বলেই তো এত খাদ্যাভাব, এত বাসস্থানের অভাব, আর তাই ক্রাইমও বেড়ে চলছে। তবে লোকগুলোকে বাহবা না দিয়ে পারছি না!
কাদের কথা বলছিস?
কেন? যারা স্বর্ণর ব্যবসায়ে নেমেছে! যারা নির্মলশিবের মাথার চুলগুলো প্রায় পাকিয়ে তুলল!
হাসলাম আমি সশব্দে।
না রে না, হাসি নয়। কথায়ই তো আছে—অভাবে স্বভাব নষ্ট, কিন্তু আমি ভাবছি–
কি?
ভেক না নিলে তো ভিক্ষার্জন হয় না! তা কিসের ভেক নিয়েছে তারা ঐ স্বর্ণমৃগয়ায়? বলত বলতে চড়কভাঙার কাছাকাছি এসে থেমে পড়ল ও।
কি রে, থামলি কেন?
বিরাট ঐ নিয়ন-বোর্ডটা লক্ষ্য করেছিস? লাল সবুজের ঝিলিক হেনে জ্বলছে। নিভছে! মাসছয়েক আগেও তো ওটা দেখেছি বলে কই মনে পড়ছে না।
কিরীটীর কথায় সামনের দিকে তাকাতেই নজরে পড়ল, বিরাট একটি নিয়নবোর্ড চারতলা একটা নতুন বাড়ির একতলার মাথায় জ্বলছে নিভছে।
ওভারসিজ লিঙ্ক।
বিচিত্র নামটা।
নিচে লেখা গভর্মেন্ট কনট্রাকটার অ্যান্ড জেনারেল অর্ডার সাপ্লায়ার।
বাড়িটা তো দেখছি নতুন! কিরীটী পুনরায় মৃদুকণ্ঠে বললে।
হ্যাঁ, তবে একেবারে নতুন নয়, বছরখানেক হল বাড়িটা তৈরি হয়েছে।
ওভারসিজ লিঙ্ক কারবারটিও তাহলে নতুনই বল!
ফুটপাতের উপর দাঁড়িয়েই দেখলাম সে সেই নতুন চারতলা বাড়িটাই লক্ষ্য করছে।
লক্ষ্য করতে করতেই আবার একসময় বললে, দোতলা তিনতলা আর চারতলা–দেখছি ফ্ল্যাট সিস্টেমে ভাড়া দিয়েছে। কিন্তু–
কিন্তু কি?
ব্যবসার আড্ডা ছেড়ে এখানে এসে অমন জাঁকজমক করে অফিস খুলেছে–
সে অঞ্চলে হয়ত তেমন মনোমত বাড়ি পায়নি।
তা বটে। বলতে বলতে লক্ষ্য করি, সেই অফিসের দিকেই এগুচ্ছে কিরীটী।
একটু অবাক হয়েই প্রশ্ন করি, কোথায় চললি?
চল একবার অফিসটায় ফুঁ দিয়ে আসা যাক। খোলাই যখন আছে, এখনও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে!
তা যেন হল, কিন্তু হঠাৎ অর্ডার সাপ্লাই অফিসে তোর কি প্রয়োজন পড়ল?