কেন? নির্মলশিব আবার প্রশ্ন করে।
কারণ চিরঞ্জীব যে মারাত্মক খেলায় মেতেছিল—অর্থাৎ নোটজাল ও সোনার চোরাকারবার, তার মধ্যে দুর্বল প্রকৃতির নারীর স্থান নেই। এবং সীতা যদি তার জীবনের সঙ্গে ঐভাবে জড়িয়ে না পড়ত, চিরঞ্জীবের আজকের এই পরাজয় ঘটত কিনা সন্দেহ।
.
২৬.
কিরীটী বলতে লাগল, যাই হোক হ্যামিলটনকে দলে নিলেও চিরঞ্জীব কোনদিন তার উপরে সম্ভবত পূর্ণ আস্থা রাখতে পারে নি। তাই দলের মধ্যে তাকে সক্রিয় হতে দেয় নি।
তবে?
কিন্তু সীতার জন্য তাকে হাতের মুঠোর মধ্যে রাখার প্রয়োজন ছিল, তাই হাতে রেখেছিল তাকে নেশার খোরাক যুগিয়ে।
নেশা।
হুঁ, নেশা। মদের নেশা। এবং বোকা সরল প্রকৃতির আর্থার হ্যামিলটনকে সেইভাবে নেশাগ্রস্ত করে হাতের মুঠার মধ্যে নিতে কাঞ্জিলালকে খুব বেশি বেগ পেতে হয় নি। যাই হোক ঐভাবে চলছিল, এমন সময় দ্বিতীয় মারাত্মক ভুল করল কাঞ্জিলাল।
কি?
হ্যামিলটনকে নেগলেকটেট করে। সীতাকে হাতের মুঠোর মধ্যে পাওয়ার পর চিরঞ্জীব হ্যামিলটনের আগের মত নেশার খোরাক যোগানোর ব্যাপারে যখন হাত গুটিয়ে নিল তখনই শুরু হল গোলমাল। তা ছাড়া আর একটা গোলমাল ইতিমধ্যে শুরু হয়েছিল।
কি?
লাভের ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে গোলমাল। যার ফলে দলের কেউ হয়তো আক্রোশের বশেই পুলিশকে উড়ো চিঠি দেয়। এবং যার ফলে একজনকে ইহজগৎ থেকে সরতে তো হলই, সেই সঙ্গে মোহিনীমোহনকেও চিরঞ্জীরের ব্যাপারে মাথা গলানোর জন্য সরতে হল। এবং শেষ পর্যন্ত এসব ক্ষেত্রে যা হয়, দলপতির সন্দেহটা তখন ক্রমশ এত তীব্র হয়ে উঠতে থাকে দুচারজনকে সেই সন্দেহের আগুনে পুড়ে মরতে হয়—ভিখনকে সেই কারণেই প্রাণ দিতে হয়েছে।
একটা কথা মিঃ রায়। নির্মলশিব প্রশ্ন করে ঐ সময়।
কি বলুন?
সীতা কি চিরঞ্জীবের সব ব্যাপার জানত?
সীতা ভিতরের ব্যাপরটা পুরোপুরি প্রথম দিকে না জানতে পারলেও শেষটায় বোধ হয় সন্দেহ করেছিল।
আর হ্যামিলটন?
হ্যামিলটন বোধ হয় তা জানতে পেরেছিল। তবে জানতে পারলেও বেচারীর তখন আর মুখ খুলবার শক্তি নেই, কারণ রেসের ময়দান ও মদের বোতল তখন তাকে গ্রাস করেছে। ঐ দুটি মারাত্মক নেশায় কাঞ্জিলালই হ্যামিলটনকে মজিয়েছিল ক্রমে ক্রমে এবং সেই নেশার সুযোগেই তাকে একদিন সম্পূর্ণ গ্রাস করেছিল সে কথা তো আগেই বলেছিল।
তারপর?
তার পরের ব্যাপারটাই শেষোক্ত ট্রাজেডির মূল।
কি রকম?
নেশায় ও অর্থের দৈন্যে এবং সীতাকে হারিয়ে পর্যদস্ত ও নিষ্পিষ্ট আর্থার হ্যামিলটন এসব ক্ষেত্রে যা হয় শেষ পর্যন্ত তাই করেছিল।
কি?
সেও শেষ পর্যন্ত মাত্র দশদিন পূর্বে মরণ কামড় দিল।
কি রকম?
পুলিসের কর্তাকে বেনামী চিঠি দিল। কিন্তু ধূর্ত কাঞ্জিলাল ব্যাপারটা জেনে ফেলল। এবং সঙ্গে সঙ্গে হ্যামিলটনকে একেবারে দুনিয়া থেকে সরাবার জন্য ভিতরে ভিতরে প্রস্তুত হতে লাগল।
কিন্তু হ্যামিলটনকে সরানো কি কাঞ্জিলালের মত লোকের পক্ষে খুব কষ্টসাধ্য ছিল? প্রশ্ন করলাম আমি।
ছিল না নিশ্চয়ই, তবে সে পারেনি দুটো কারণে!
দুটো কারণে?
হ্যাঁ, প্রথমত কাঞ্জিলাল খুব ভালবাবেই জানত আর্থার হ্যামিলটনের সঙ্গে সীতার সেপারেশন হয়ে গেলেও সীতা আজও তাকে ভুলতে পারে নি। দ্বিতীয়ত হ্যামিলটনকে। সরালে সীতাকে হারাতে হবে তার। সীতাকে কাঞ্জিলাল সত্যিই ভালবেসেছিল সে তো আগেই বলেছি। মদনের ফুলশর নয়, এখানে রতির বঙ্কিম কটাক্ষই শেষ পর্যন্ত অঘটন ঘটাল। তবে একটা কথা এখানে স্বীকার না করলে অন্যায়ই হবে।
কি? প্রশ্ন করে নির্মলশিববাবু।
সারা দক্ষিণ কলকাতার রাস্তা জুড়ে যদি মোহিনীমোহনের লাসটা অতিরিক্ত দম্ভে কাঞ্জিলাল টুকরো টুকরো করে না ছড়িয়ে দিত তো বিশেষ করে দক্ষিণ কলকাতার উপরেই দৃষ্টি আমার আকর্ষিত হত না। এবং সেদিনও রাত্রে বের হয়ে ঘুরতে ঘুরতে ওভারসিজ লিঙ্কের উপরে আর নজর পড়ত না। এবং ওভারসিজ লিঙ্কে নেহাত কৌতূহলের বশে প্রবেশ করার পর সেখানে ঘটোৎকচ ও সীতা দেবীর দর্শন না পেলে ও সেদিনকার সেই ঘটনাটা না ঘটলে হ্যামিলটনকে ঘিরে ওভারসিজ লিঙ্কের উপরে সন্দেহটা আমার ঘনীভূত হত না।
কিন্তু এসব কথা তুই জানলি কি করে?
কিছুটা অনুমান, কিছুটা অন্তদৃষ্টি, কিছুটা অনুসন্ধান ও বাদবাকি আর্থার হ্যামিলটনের মুখে।
আর্থার হ্যামিলটনের মুখে!
হ্যাঁ।
কি আশ্চর্য! তাহলে চিরঞ্জীব কাঞ্জিলালই সব রহস্যের মেঘনাদ! শুধালেন নির্মলশিববাবু।
হ্যাঁ, তবে আর একটা মাস দেরি হলে চিরঞ্জীব ঠিক নাগালের বাইরে চলে যেত, কারণ যে সোনা সে চুরি করে হস্তগত করেছিল তার বোধ হয় সবটাই সে মোটা মুনাফা রেখে বিদেশে পাচার করে দিতে পেরেছিল। ওভারসিজ লিঙ্কের কারবার। সে হয়তো এভাবে শীঘ্রই গুটিয়ে নিত। কিন্তু কথায় বলে-ধর্মের কল। ঠিক সময়েই ঘটনাচক্রে যোগাযোগটা এমন হয়ে গেল যে চিরঞ্জীবের আর পালানো হল না।
পালাত মানে? পালালেই হল নাকি? নির্মলশিব সদম্ভে বলে ওঠে।
পালাত? আর একবার জাল গুটিয়ে নিলে স্বয়ং কিরীটী রায়েরও সাধ্য ছিল না চিরঞ্জীবের চুলের ডগাটি স্পর্শ করে।
সত্যি বলছেন মিঃ রায়?
এতটুকুও অত্যুক্তি নয়। ও যে কত বড় শয়তান আপনারা জানেন না এখনও, কিন্তু আমি তার সম্যক পরিচয় পেয়েছি। তবে দুঃখ রয়ে গেল, শেষ পর্যন্ত সীতাকে