হস্তধৃত সিগারটা ইতিমধ্যে কথা বলতে বলতে নিভে গিয়েছিল।
সেটায় পুনরায় অগ্নিসংযোগ করে গোটা দুই টান দিয়ে কিরীটী তার অর্ধসমাপ্ত কাহিনীর পুনরাবৃত্তিতে ফিরে এল।
কিরীটী বলতে লাগল, চায়না টাউন হোটেল ও বারুইপুরের ঘাঁটি বাদে অন্যান্য ঘাঁটি হল তার, ওভারসিজ লিঙ্ক, পান্থ পিয়াবাস রেস্তোরাঁ ও লাটুবাবুর গ্যারাজ এবং নিজেকে ও সেই সঙ্গে নোট জালের কারখানাটি আড়াল করে রাখবার জন্য আমদানি হল উর্বশী সিগারেট।
.
২৫.
কিরীটী বলতে লাগল, চিরঞ্জীব কাঞ্জিলালের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল সর্বপ্রথম ফ্রান্সিস–আমাদের ঘটোৎকচ বা পিয়ারীলাল। তারপর এল, পানওয়লা ভিখন ও পান্থ পিয়াবাসের মালিক কালীকিঙ্কর সাউ। এবং সর্বশেষ আমাদের হ্যামিলটন ও তার সুন্দরী স্ত্রী সীতা হ্যামিলটন।
আর্থার হ্যামিলটনের মনের মধ্যে অর্থের প্রতি লোভ থাকলেও দুবুদ্ধি ছিল না আগেই বলেছি। এবং স্ত্রীর সঙ্গে তার নেশার ব্যাপারে প্রায়শই খিটমিটি লেগে থাকলেও কেউ তারা স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের কাছ থেকে সেপারেশনের কথাও বোধ হয় ভাবতে পারে নি।
এমন সময় চিরঞ্জীব কাঞ্জিলালের আগমন ঘটল অকস্মাৎ একদিন ঘটোৎকচের সঙ্গে বর্ধমানে হ্যামিলটনের রেলওয়ে কোয়ার্টারে কোন এক নিদারুণ অশুভক্ষণে। এবং এবারের ইতিহাস যা আমাকে কিছু কিছু বলেছিল আর্থার হ্যামিলটন এবং বাকিটা আমার অনুমানের উপরে নির্ভর করে আমি গড়ে তুলেছি।
এতক্ষণে যেন কিরীটীর কথায় অকস্মাৎ আমাদের সকলেরই আর্থার হ্যামিলটনের কথাটা মনে পড়ল।
বর্তমান নাটকে বিশিষ্ট একটি স্থান নিয়েও আর্থার হ্যামিলটনকে যেন আমরা সীতার করুণ ট্রাজেডির সঙ্গে জড়িত হয়ে ও চিরঞ্জীব কাঞ্জিলালের প্রসঙ্গে একপ্রকার ভুলেই গিয়েছিলাম।
তাই হ্যামিলটনের কথা মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমিও বললাম, আর্থার এখন কোথায় তুই জানিস কিরীটী?
জানি।
কোথায়?
বর্তমানে সে আসানসোলে তার এক আত্মীয়ের বাসায় পুলিসের সতর্ক প্রহরায়। রয়েছে।
আসানসোলে?
হ্যাঁ।
কবে সেখানে গেল?
কাল রাত্রের ট্রেনে। আমিই অবিশ্যি ডি. সি.-কে বলে ব্যবস্থা করেছি।
সীতার ব্যাপারটা আর্থার জানে না বোধ হয়?
না।
কিন্তু একটা কথা বুঝতে পারছি না কিরীটী–
কি?
আর্থারের ব্যবস্থা যখন তুই করেছিলিই, সেরাত্রে সীতাকে চায়না টাউনে যেতে দিলি কেন?
না যেতে দিলে চিরঞ্জীব কাঞ্জিলালকে আজ তো হাতেনাতে ধরতে পারতাম না। কিন্তু তাকে যেতে দিয়ে আমি ভুল করি নি-ভুল করেছি তাকে একা যেতে দিয়ে। কারণ আমার ধারণা ছিল—
কি?
কাঞ্জিলাল হয়তো শেষ পর্যন্ত হত্যা করবে না!
হঠাৎ অমন বিদঘুটে ধারণাটা কেন হল আপনার মিঃ রায়? প্রশ্নটা করলে নির্মলশিববাবু।
কারণ আমি জানতাম, সীতাকে সত্যি ভালবাসে কাঞ্জিলাল।
কিসে বুঝলেন সেটা?
শেষ মুহূর্তে যে কাঞ্জিলাল সীতাকে চরম আঘাত হেনেছিল, সেই একটিমাত্র ঘটনা থেকেই। যাকে ভালবসেছি বলে আগাগোড়া জেনে এসেছি এবং সেও আমাকেই ভালবাসে বলে জেনে এসেছি হঠাৎ যখন কোন এক মুহূর্তে সেই জানাটা মিথ্যা হয়ে যায়—অর্থাৎ জানতে পারি আমার জানাটা ভুল, সেই মুহূর্তে যে হিংসার আগুন জ্বলে ওঠে তা বড় ভয়ঙ্কর। কাঞ্জিলালেরও হয়েছিল ঠিক তাই। কাঞ্জিলাল যে মুহূর্তে জানতে পারলে সীতা আজও আর্থার হ্যামিলটনকে ভুলতে পারে নি, যতই দূরে যাক সে আজও তার সমস্ত বুকটা জুড়ে রয়েছে তার ভূতপূর্ব স্বামী হ্যামিলটনই, খুব সম্ভবত চিরঞ্জীবের বুকের মধ্যে সঙ্গে সঙ্গে জ্বলে উঠেছিল হিংসার ভয়াবহ আগুন, যে আগুনে সীতাকে তো সে ধ্বংস করলই, নিজেরও চরম সর্বনাশকে ডেকে আনল। যে পুলিশ গত এই কয় বছর ধরে তার বহুবিধ দুষ্কৃতির সন্ধান পেয়েও তাকে ধরতে বা ছুঁতে পারে নি, সেই পুলিসের হাতেই ধরা পড়ল আজ সে।
চিরঞ্জীব যে সীতাকে ভালবাসে জানলেন কি করে মিঃ যায়? নির্মলশিব প্রশ্ন করে।
কেন, আপনার লোকরা চায়না টাউনের প্রোপাইটার চিরঞ্জীবের ঘর সার্চ করে যেসব জিনিসপত্র নিয়ে এসেছিল সেদিন, তার মধ্যে আপনি কোন উল্লেখযোগ্য বস্তু না পেলেও তার ঘরে যে বাঁধানো বাইবেলটি আপনার লোকরা এনেছিল তার মধ্যে একটি ফটো আমি পেয়েছিলাম—বলতে বলতে কিরীটী ছোট একটা ফটো বের করে আমাদের সামনে তুলে ধরল।
ফটোটা চিরঞ্জীব কাঞ্জিলালের।
নির্মলশিব ফটোটার দিকে তাকিয়ে বললে, এ তো চিরঞ্জীবের ফটো দেখছি, মিঃ রায়। হ্যাঁ তারই, তবে
তবে আবার কি? এর পিছনের লেখাটা পড়লেই আপনার ঐ তবের উত্তর পাবেন। এই দেখুন–কিরীটী ফটোটা উলটে ধরল।
দেখলাম তার পিছনে ইংরাজীতে লেখা আছে কালি দিয়ে
To my darling Sita
Chiranjib
এবং তার নিচে যে তারিখটা রয়েছে সেটা এক বৎসর পূর্বের।
কিরীটী বলতে লাগল, ফটো এবং এই লেখাটুকুই চিরঞ্জীব-সীতা-রহস্য আমার কাছে। পরিষ্কার করে দিয়েছিল।
কিন্তু এ ফটো চিরঞ্জীবের ঘরে বাইবেলের মধ্যে এল কি করে? প্রশ্ন করল নির্মলশিববাবু।
খুব সম্ভবত–আমার অনুমান, পরে দুজনার মধ্যে আর্থার হ্যামিলটনকে নিয়ে মনোমালিন্য হওয়ায় হয় সীতাই চিরঞ্জীবকে ফটোটা ফিরত দিয়েছিল, না হয় চিরঞ্জীবই চেয়ে নিয়েছিল সীতার কাছ থেকে। সে যাক, হ্যামিলটন পর্বটা এবারে শেষ করি। হ্যামিলটনকে দলে সম্ভবত চিরঞ্জীব টেনে নিয়েছিল সীতার আকর্ষণে। যদিচ চিরঞ্জীবের জীবনে সেটাই সর্বাপেক্ষা বড় ভুল হয়েছিল।