অস্ফুট কণ্ঠ দিয়ে আমাদের বের হয়ে এল। একি! কাঞ্জিলাল।
হ্যাঁ, কাঞ্জিলাল। চিরঞ্জীব কাঞ্জিলাল।
.
২৪.
আশ্চর্য।
চিরঞ্জীব কাঞ্জিলাল!
কিরীটী মৃদু হেসে অদূরে দণ্ডয়মান চিরঞ্জীব কাঞ্জিলালের মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, হ্যাঁ, আপাতত তাই মনে হলেও ঐ নামটিও কিন্তু ওর আসল আদি ও অকৃত্রিম নাম বা পরিচয় নয়। ছদ্মবেশের মত ওটিও আর একটি ছদ্মনাম!
ছদ্মনাম?
হ্যাঁ। মহৎ ব্যক্তি ও গুণীজন কিনা—তাই ভদ্রলোক অনেক নামেই পরিচিত।
আরও নাম ওর আছে? শুধাল এবারে নির্মলশিববাবুই।
আছে। আমি অবিশ্যি আর দুটি নাম জানি।
আরও দুটি নাম ওর জানেন?
জানি। বোম্বাই শহরে বৎসর-চারেক পূর্বে উনি বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন, মিঃ রাখন নামে। এবং তার পূর্বে বছর সাতেক আগে ছিলেন মাদ্রাজে-সেখানে নাম নিয়েছিলেন মিঃ অবিনাশলিঙ্গম।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। তিন-চারটি ভাষা ওঁর আয়ত্তে।
তবে ওর আসল নামটা কি? নির্মলশিব প্রশ্ন করে।
আসল নামটি যে কি একমাত্র বলতে পারেন উনিই! বলেই চিরঞ্জীববের দিকে তাকিয়ে কিরীটী প্রশ্ন করল, বলুন না মিঃ কাঞ্জিলাল, আপনার আসল, আদি ও অকৃত্রিম নামটা কি?
বলাই বাহুল্য কাঞ্জিলাল নিরুত্তর রইল।
কেবল কুদ্ধ জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল নিঃশব্দে আমাদের দিকে।
কিরীটী মৃদু হেসে বলে, বোবার শত্রু নেই নির্মলশিববাবু। এতএব উনি বোবা, মৌনী। যাকগে—এখানে আর নয়, চলুন বাইরে যাওয়া যাক।
.
আমরা পুনরায় নির্মলশিবের অফিসঘরে ফিরে এলাম।
একটা চেয়ারে বসে একটা চুরুটে অগ্নিসংযোগে মনোনিবেশ করে কিরীটী।
আমিই এবারে শুধোই, ওকে তাহলে তুই পূর্ব হতেই সন্দেহ করেছিলি?
হ্যাঁ, চায়না টাউন হোটেলে ওকে যেদিন প্রথম দেখি, বলা বাহুল্য আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়েই চমকে উঠেছিলাম, কারণ ওর ঐ দুটি চোখ মনের পাতায় আমার অনেকদিন থেকেই গাঁথা ছিল।
ওকে তুই পূর্বে দেখেছিলি?
চাক্ষুষ নয়-ফটোতে।
ফটোতে।
হ্যাঁ, ক্রিমিনাল রেকর্ড সেকশনের দপ্তরে ওদের মত বহু চিহ্নিত গুণীজনদের যেসব নানাবিধ পরিচিতি সংরক্ষিত থাকে সেই রকমই একটা ফটোর অ্যালবামে ওর চেহারার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে। ফটোতে সেই সময় ওরই চোখ দুটি সেদিনই আমার দৃষ্টিকে আকর্ষণ করেছিল। এবং সেইদিনই ডি.সি.-কে আমি বলেছিলাম, চোখের ঐ দৃষ্টি একজন সাধারণ কালপ্রিটের নয়, রক্তের মধ্যে যাদের ক্রাইমের বিষাক্ত বীজ থাকে ও চোখের দৃষ্টি তাদেরই।
আমরা যেন মন্ত্রমুগ্ধের মত কিরীটীর বিশ্লেষণ শুনতে থাকি।
কিরীটী বলতে থাকে, সেই সময় ডি. সি.-র কাছে লোকটার কিছু পরিচয় আমি পাই। কারণ লোকটা সম্পর্কে জানতে আমার সত্যিই আগ্রহ হয়েছিল। কিন্তু ডি. সি. আমাকে বিশেষ কোন ইনফরমেশন লোকটার সম্পর্কে দিতে পারলেন না, বোম্বাই এবং মাদ্রাজের ব্যাপারটুকুই কেবল আমাকে সে সময় তিনি বললেন। মামলাটা ছিল সোনার চোরাই কারবার ও নোটজালের ব্যাপার। কিন্তু সে সময় লোকটিকে ধরেও স্থানীয় পুলিসের কর্তারা জোরালো প্রমাণের অভাবে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল ওকে।
তারপর? রুদ্ধশ্বাসে প্রশ্ন করে নির্মলশিববাবু।
তারপর বেশ কিছুদিন লোকটার আর কোন পাত্তাই পাওয়া যায় না এবং শ্রীমান যে ইতিমধ্যে কলকাতা শহরে এসে চিরঞ্জীব কাঞ্জিলাল নাম নিয়ে তার কর্মের জাল বিছিয়েছে পুলিসের কর্তৃপক্ষ এতদিন স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি।
তারপর?
তারপর সেদিন যখন ওকে আমি হ্যামিলটনকে অনুসরণ করতে করতে গিয়ে চায়না টাউন হোটেলে প্রথম দেখলাম, আমি আর কালবিলম্ব করিনি। সঙ্গে সঙ্গে পুলিসের দৃষ্টি ওর ওপরে আমি আকর্ষণ করাই এবং অনুসন্ধানের ফলে বিচিত্র এক ইতিহাস আমরা জানতে পারি।
ইতিহাস?
হ্যাঁ, সেই ইতিহাসই এবার বলব। প্রথমে মাদ্রাজ এবং পরে বোম্বাই থেকে পুলিসের তাড়ায় কারবার গুটিয়ে সম্ভবত চিরঞ্জীব—ঐ নামেই বলব, কলকাতায় চলে আসে সোজা। কলকাতায় এসে তার পরিচয় হয় ঘটোৎকচ—অর্থাৎ আমাদের পিয়ারীলালের সঙ্গে। পিয়ারীলাল লোকটা দুর্ধর্ষ ও শয়তান কিন্তু চিরঞ্জীবের মত তার কূটবুদ্ধি ছিল না। পিয়ারীলাল তখন চায়না টাউন হোটেলটি একজনের কাছ থেকে ষড়যন্ত্র করে বাগিয়ে নিয়ে সবে হোটেলটির মালিক হয়েছে। পিয়ারীলালের সঙ্গে দোস্ত পাতিয়ে চিরঞ্জীব ঐ চায়না টাউন হোটেলই আস্তানা নিল। তারপর পিয়ারীলালের মাথায় হাত বুলাতে কাঞ্জিলালের বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। অতি সহজেই সে হোটেলটি গ্রাস করে নিল। এবং তার একটা পাকাপাকি নিশ্চিন্ত আস্তানাও হল। আস্তানা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিরঞ্জীব আবার পুরাতন কারবার অর্থাৎ নোটজাল ও সোনার চোরাকারবারে মন দিল। একে একে সোনার লোভে লোভে চিরঞ্জীবের দলে লোক এসে জুটতে লাগল।
কিন্তু আর্থার হ্যামিলটন ও তার স্ত্রী সীতা!
সেই কথাই এবারে বলব। ঘটোৎকচের পিয়ারীলালও আসল নাম নয়।
তবে?
ওর আসল নাম হচ্ছে ফ্রান্সিস মূর। নেটিভ ক্রিশ্চান। ফ্রান্সিস আর আর্থার ছিল দীর্ঘদিনের বন্ধু।
বন্ধু!
হ্যাঁ। কিন্তু বন্ধুত্বটা যে কিভাবে এত গাঢ় হয়েছিল সেটাই বিচিত্র। কারণ আর্থার তার বন্ধুর মত শয়তান ছিল না। তবে মনের মধ্যে লোভ ছিল অর্থের এবং আমার মনে হয় ঐ লোভই হয়েছিল তাদের পরস্পরের বন্ধুত্বের বাঁধন। যাই হোক যা বলছিলাম তাই বলি। চিরঞ্জীব কলকাতায় স্থিতি হবার পর তার ওভারসিজ লিঙ্ক কোম্পানি গড়ে তুলল। এবং বরাবর যেমন সে করে এসেছে এবারেও তেমনি ওভারসিজ লিঙ্কই নয়–সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে এবং তার আসল কারবারকে পুলিসের শ্যেনদৃষ্টি থেকে বাঁচাবার জন্য আরও কয়েকটি উপঘাঁটি গড়ে তুলল। অবশ্যই প্রত্যেকটি উপঘাঁটিই কাছাকাছি গড়ে তুলল, কেবল বিশেষ দুটি ঘাঁটি ছাড়া—প্রথম তার নিজের বাসস্থানটি ও দ্বিতীয় নোটজালের কারখানাটি দূরে দূরে রইল।