আমার জীপে করেই তাহলে নিয়ে যাই?
হ্যাঁ, সেই ব্যবস্থাই ভাল হবে। চলুন—আর দেরি নয়।
বলতে বলতে কিরীটী নিজেই নিচু হয়ে রক্তাক্ত সংজ্ঞাহীন সীতার দেহটা দুহাতে বুকের উপরে তুলে নিল।
নির্মলশিব বন্দী আর্থার হ্যামিলটনকে নিয়ে অগ্রসর হল।
আর্থার হ্যামিলটন যেন একেবারে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।
বিনা প্রতিবাদে সে চলতে লাগল।
.
শেষ পর্যন্ত কিন্তু জীপে তোলা গেল না সীতার দেহটা।
কাজেই হরগোবিন্দের গাড়িতেই দেহটা ভোলা হল।
সেই গাড়িতেই আমি ও কিরীটী উঠলাম।
কিরীটীর নির্দেশে বন্দী আর্থার হ্যামিলটনকে নিয়ে জীপে উঠে বসল নির্মলশিববাবু।
স্থির হল হাসপাতালে সীতাকে পৌঁছে দিয়ে আমরা থানায় যাব।
.
২৩.
পরদিন বেলা সাতটা নাগাদ কিছুক্ষণের জন্য সীতার জ্ঞান হল।
কিরীটী ও আমি এবং নির্মলশিববাবু তিনজনেই সীতার বেডের সামনে ছিলাম। কিন্তু বিশেষ কিছুই বলবার ক্ষমতা তখন আর ছিল না সীতার।
নিদারুণভাবেই সে আহত হয়েছিল, মারাত্মক ছুরির আঘাতে। তার উপরে অতিরিক্ত, রক্তস্রাব।
সীতাকে চোখ মেলে তাকাতে দেখেই কিরীটী তার মুখের উপরে ঝুঁকে পড়ে।
কিছু বলবেন সীতা দেবী?
ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকে সীতা কিরীটীর মুখের দিকে।
কোন কথাই যেন বলতে পারে না।
ঠোঁট দুটো থর থর করে কাঁপতে থাকে কেবল।
বলুন কিছু যদি বলতে চান? কিরীটী আবার বলে।
আর্থার—
হ্যাঁ বলুন, আর্থার কি?
তাকে-তাকে! বোধ হয় শেষ পর্যন্ত বাঁচাতে পারলাম না মিঃ রায়।
আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, হি ইজ সেভড।
বেঁচেছে? সে-সে-
হ্যাঁ, সেই অক্ষতই আছে।
অক্ষত আছে? হি ইজ সেভড়? থ্যাঙ্ক গড।
শেষের কথাগুলো যেন ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে গেল।
দুচোখের কোল বেয়ে দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।
আমারও চোখে জল এসে যায়।
ঐদিনই।
থানায় বসে কিরীটী বলছিল, বেচারী সীতার ঐ করুণ পরিণতির ব্যাপারে কোন দিনই বোধ হয় নিজেকে আমি ক্ষমা করতে পারব না!
নির্মলশিববাবু প্রশ্ন করে, কেন ও কথা বলছেন মিঃ রায়?
কারণ সীতার ঐ পরিণতির জন্য আমিই বোধ হয় দায়ী।
আপনি?
নিশ্চয়ই সীতার ব্যাপারে অতবড় মারাত্মক ভুলটা যদি না করতাম।
ভুল?
ভুল বৈকি। সীতাকে যদি আমি কাল রাত্রে একাকী না ছেড়ে দিতাম তবে তো তাকে ঐ দুর্ঘটনার সম্মুখীন হতে হত না। হ্যামিলটনকে বাঁচাতে পারবে ভেবেই সীতাকে আমি যেতে দিয়েছিলাম এবং সেটা যে আমার কত বড় ভুল–
কিন্তু একটা কথা আমি এখনও বুঝে উঠতে পারি নি মিঃ রায়!
কি?
শেষ পর্যন্ত স্কাউন্ট্রেলটাকে বাঁচানোর জন্য আপনারই মাথাব্যথা হয়েছিল কেন?
ঐখানেই তো আপনি ভুল করছেন নির্মলশিববাবু!
ভুল করেছি মানে?
নিশ্চয়ই, কারণ সত্যি সত্যিই লোকটা স্কাউন্ট্রেল নয়। বরং বলতে পারেন হতভাগ্য!
হতভাগ্য?
হ্যাঁ। অমন স্ত্রী আর তার ভালবাসা পেয়েও নচেৎ লোকটার আজ এই পরিণতি হয়? তাকে দুর্ভাগা ছাড়া আর কি বলব বলুন?
লোকটার প্রতি দেখছি এখনও আপনার মমতার অন্ত নেই। একটা ডায়বলিক্যাল মার্ডারার!
মার্ডারার?
নিশ্চয়ই। খুনী—
কে খুনী? হ্যামিলটন? কিন্তু সে তো খুনী নয়।
খুনী নয় মানে?
অতি প্রাঞ্জল, সে হত্যা করেনি সীতাকে।
কথাটায় এবারে আমিও চমকে উঠি।
কি বলছিস কিরীটী?
কিরীটী শান্ত মৃদুকণ্ঠে বলে, ঠিকই বলছি—সে খুন করে নি।
কিন্তু–
লোকটা হ্যামিলটনের মত দেখতে তাই তো? বলতে বলতে মৃদু হাসে কিরীটী।
অতঃপর প্রশ্নটা না করে পারি না।
শুধাই, কে—কে তবে ঠিক হ্যামিলটনের মতই অবিকল দেখতে লোকটা?
হ্যামিলটনের ছদ্মবেশে আসল খুনী।
ছদ্মবেশে!
হ্যাঁ, হাজতঘরে গেলেই তোমাদের ভুল আমি ভেঙে দিতে পারব।
কিরীটীর কথায় সঙ্গে সঙ্গে নির্মলশিব উঠে দাঁড়ায় এবং বলে চলুন, এক্ষুনি চলুন। আমার সব কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে মিঃ রায়!
বেশ, চলুন।
সকলে আমরা হাজতঘরের দিকে অগ্রসর হলাম।
থানার লকআপেই লোকটা তখনও ছিল এবং লকআপে থাকলেও কিরীটীর পূর্ব নির্দেশমত তার হাতে হাতকড়া দেওয়া ছিল।
আমরা সকলে এসে থানার সেই লকআপের মধ্যে তালা খুলে ঢুকলাম। দিনের বেলাতেও ঘরটার মধ্যে আলো না জ্বাললে ভাল করে সবকিছু দৃষ্টিতে আসে না।
আমাদের পদশব্দে সে ফিরে তাকাল।
লোকটার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই কেন যেন বুকটার মধ্যে শিরশির করে ওঠে। রুদ্ধ আক্রোশে পিঞ্জরাবদ্ধ বাঘের মতই যেন চোখ দুটো তার জ্বলছিল তখন।
কিন্তু কিরীটী একটু আগে কি বলল? এ তো আর্থার হ্যামিলটনই।
কিরীটী।
আমার ডাকে কিরীটী মৃদু হেসে বললে, এখনও মনে হচ্ছে আর্থার হ্যামিলটনই, তাই না।
আমি এবং নির্মলশিব দুজনাই কিরীটীর মুখের দিকে তাকাই, কিন্তু ভাল করে ওর চোখের দিকে তাকালেই বুঝতে পারবি সে নয়। তোদের কেন, সকলেরই ঐ ভুল হওয়াটা একান্তই স্বাভাবিক। তবে হ্যামিলটনের অপূর্ব ছদ্মবেশ নেওয়া সত্ত্বেও আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়েই গতকাল বুঝতে পেরেছিলাম-চিনতে পেরেছিলাম ও আসলে কে? ওর ঐ দুটো চোখই আমাকে ওর সত্যকারের পরিচয় দিয়েছিল—ওর ছদ্মবেশ নেওয়া সত্ত্বেও। হ্যাঁ, তোমাদের সকলকে ফাকি দিতে পারলেও ও আমাকে ফাকি দিতে পারে নি Now you see–
বলতে বলতে এগিয়ে গিয়ে লোকটার দাড়ি ধরে একটা হেঁচকা টান দিতেই স্পিরিটগামের সাহায্যে লাগানো ফলস্ মেকআপের দাড়ি গোঁফ কিরীটীর হাতের মুঠোর মধ্যে চলে এল এবং সঙ্গে সঙ্গে আমি চমকে উঠলাম এতক্ষণে লোকটাকে চিনতে পেরে। আর্থার হ্যামিলটন নয়। কাঞ্জিলাল।