বিশ্বাস করুন আপনি, আপনার এই চিঠির অর্থটা জানবার জন্যেই আমি এসেছি।
সত্যিই কি এখনও আপনি বলতে চান সীতা দেবী, চিঠির অর্থ আপনি বোঝেননি? সত্যিই কি আপনি বলতে চান আপনার নিজের বর্তমান অবস্থার গুরুত্বটা আপনি এখনও বুঝতে পারেননি?
আমার বর্তমান অবস্থার গুরুত্ব!
হ্যাঁ, মৃত্যু আপনার সামনে আজ এসে ওৎ পেতে দাঁড়িয়েছে।
মৃত্যু কথাটার সঙ্গে সঙ্গেই যেন চমকে তাকায় সীতা কিরীটীর মুখের দিকে।
কিরীটী নির্মম কণ্ঠে বলতে লাগল, আপনি জানেন না এখনও কিন্তু আমি জানি সীতা দেবী, যে দলের সঙ্গে আজ আপনি ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হোক ভিড়েছেন তাদের আসল ব্যাপারটা কি! ওভারসিজ লিঙ্কের আসল ও সত্যিকার ব্যাবসাটা জানেন কি?
জানি বৈকি, কেমিক্যালস, চা, সিগারেট।
জোর গলাতেই কথাগুলো সীতা মৈত্র বলবার চেষ্টা করলেও যেন মনে হল গলাটা তার শুকিয়ে উঠেছে।
দু চোখে শঙ্কাব্যাকুল দৃষ্টি।
কিন্তু ওগুলো তো বাহ্য। আসলে যে মৃগয়া ওদের চলেছে সেটা কি জানেন?
কী?
চোরাই সোনা চালান দেওয়া।
সোনা?
ছোট একটা টোক গিলে যেন প্রশ্নটা করল সীতা।
হ্যাঁ, চোরাই সোনা। যে সোনা এদেশ থেকে নানাভাবে চুরি করে, গালিয়ে, ছোট ছোট চাবির আকারে উর্বশী সিগারেটের প্যাকেটে ভরে বিদেশে চালান দিচ্ছে আপনাদের ওভারসিজ লিঙ্কের কর্তারা!
না, না—কি বলছেন আপনি?
ঠিকই বলছি।
কিরীটীবাবু, আমি সত্যিই একেবারে কিছুই জানি না।
এতক্ষণে সত্যি সত্যিই সীতা যেন ভেঙে পড়ল।
২১-২৬. আপনি জানেন না
আপনি জানেন না যে তা আমি জানি, কিরীটী বলে, কিন্তু আর্থার হ্যামিলটন জানে।
আর্থার। না না—সে অত্যন্ত নিরীহ গোবেচারি লোক। তাকে আপনারা জানেন না, কিন্তু আমি জানি। সে এসবের মধ্যে সত্যিই নেই, বিশ্বাস করুন।
আপনার সঙ্গে তো তার গত দেড় বছর ধরে কোন সম্পর্ক নেই। আপনাদের স্বামীস্ত্রীর মধ্যে তো সেপারেশন হয়ে গিয়েছে!
হয়েছে, তবু তাকে আমি জানি। সে এসবের কিছু জানে না। He is so innocent! এত নিরীহ-বলতে বলতে সীতা মৈত্রের দু চোখের কোল ছলছল করে ওঠে।
পটপট করে তার দু চোখের কোল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।
কিন্তু সীতা দেবী, পিয়ারীলাল সে কথা বিশ্বাস করে না। কিরীটী এবারে বলল।
পিয়ারীলাল! চমকে তাকায় সীতা মৈত্র কিরীটীর মুখের দিকে।
হ্যাঁ, পরশু রাত্রে সে কথা কি সে আপনাকে এসে বলে যায়নি?
ঐ কথার সঙ্গে সঙ্গে সীতার সমস্ত মুখখানা যেন একেবারে মড়ার মতই ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
আর্থার হ্যামিলটনকে সে শেষ করে দিতে চায় সেই কথাই কি গতরাত্রে পিয়ারীলাল এসে আপনাকে জানিয়ে যায়নি?
সীতা একেবারে বোবা হয়ে যায় যেন।
কয়েক মুহূর্ত তার মুখ দিয়ে কোন শব্দই বের হয় না।
কি, চুপ করে রইলেন কেন? কোথায় গাড়িতে করে যাবার কথা আছে আজ রাত্রে আপনাদের? বলুন, এখনও আর্থারকে যদি বাঁচাতে চান তো বলুন।
সীতা নির্বাক পাথর।
আর্থারকে তো আজও আপনি ভালবাসেন। কেন তবে চুপ করে থেকে তার সর্বনাশ ডেকে আনবেন মিস্ মৈত্র?
জানি না, আমি কিছু জানি না।
দু হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলল সীতা মৈত্র।
কোন ভয় নেই আপনার সীতা দেবী, নির্ভয়ে আপনি বলুন, আমি কথা দিচ্ছি আপনার নিরাপত্তার জন্য দায়ী আমি থাকব। বলুন, চুপ করে থাকবেন না!
কোথায় তাকে নিয়ে যাবে আমি জানি না, তবে—
তবে?
আজ অফিসে পিয়ারীলালকে বলতে শুনেছিলাম, আমাদের উর্বশী সিগারেটের ভ্যানটা নাকি বারুইপুরে যাবে।
বারুইপুরে?
হ্যাঁ, সিগারেটের কারখানাটা শুনেছিলাম একসময় বারুইপুরে না কি কোথায়।
হুঁ। তাহলে আমার অনুমান মিথ্যে নয়!
কিরীটী যেন অতঃপর চিন্তিতভাবে কিছুক্ষণ ঘরের মধ্যে পায়চারি করল।
তারপর একসময় পায়চারি থামিয়ে বললে, ঠিক আছে, আপনি আপনার ঘরে যান।
এখন তো আমি ঘরে যাব না—
তবে?
চায়না টাউন হোটেলে একবার যেতে হবে।
কেন, সেখানে কি?
সেখানেই আর্থার থাকে—সেখান থেকে তাকে নাকি ওরা গাড়িতে তুলে নেবে সেই। রকম কথা হয়েছে।
আপনার সঙ্গে কি সেই রকম কথা ছিল?
না। আমার এখানেই থাকবার কথা। কিন্তু—
ঠিক আছে, আপনি যান চায়না হোটেলে, আপনার কোন ভয় নেই।
যাবো?
হ্যাঁ, যান।
সীতা মৈত্র ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
.
২২.
সেই রাত্রেই।
ভবানীপুর থানায় আমি, কিরীটী ও নির্মলশিববাবু অপেক্ষা করছিলাম এমন সময় ফোনে সংবাদ এল, সীতা মৈত্র তখনও নাকি চায়না টাউনে যায়নি।
একটু অবাকই হলাম আমরা সংবাদটা পেয়ে।
রাত সাড়ে দশটা নাগাদ আমাদের ফ্ল্যাট থেকে সীতা মৈত্র বের হয়ে গিয়েছে।
এখন রাত সাড়ে এগারোটা এখনও চায়না টাউনে সে পৌঁছায়নি মানে কি?
সংবাদটা পেয়ে কিরীটী যেন একটু চিন্তিতই হয়ে ওঠে।
বলে, তবে কি সে সেখানে আদৌ পৌঁছাতেই পারল না?
কিরীটী মুহূর্তকাল যেন কি চিন্তা করে।
তারপর মৃদুকণ্ঠে ডাকে। সুব্রত।
কি?
ব্যাপারটা ভাল মনে হচ্ছে না। এদিকে হরিপদও তো এখনও পর্যন্ত কোন ফোন। করল না। উর্বশী সিগারেটের ভ্যানের সংবাদটা তার দেওয়ার কথা ছিল–
কিরীটীর কথা শেষ হল না।
ফোন বেজে উঠল।
নির্মলশিবই ফোন ধরেছিল।
কি আশ্চর্য! কে, হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি ও. সি. কথা বলছি। সন্ধ্যার সময় যে সেই ভ্যান গ্যারাজ থেকে বের হয়ে গেছে আর ফেরেনি!
ফোন রেখে দিয়ে নির্মলশিব কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল, কি আশ্চর্য। শুনলেন তো মিঃ রায়, ভ্যান এখনও ফেরেনি!