কি আশ্চর্য! বলেন কি? তাহলে তো সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে!
সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে মানে? বাক্সগুলো ছেড়ে দিয়েছেন নাকি? কিরীটী শুধাল।
তা—তা দিয়েছি,-কেমন করে জানব বলুন মশাই যে সিগারেট চালান যাচ্ছেতার মধ্যে সত্যি সত্যিই সোনা রয়েছে!
কিন্তু আমি তো আপনাকে সেই জন্যই-অর্থাৎ মালগুলো আটক করবার জন্যেই পাঠিয়েছিলাম!
কি আশ্চর্য! তা তো পাঠিয়েছিলেন—কিন্তু–
ঠিক আছে। আপনি এখুনি গিয়ে কাবুল কাস্টমসে একটাওয়ারলেস মেসেজ পাঠিয়ে দিন মালগুলো সেখানে আটক করবার জন্যে।
কি আশ্চর্য! তা আর বলতে? এখুনি আমি যাচ্ছি!
একপ্রকার যেন ছুটেই নির্মলশিব ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
কিরীটী আর একটা ফ্রাই বাটি থেকে তুলে কামড় দিতে দিতে বললে, নাঃ, ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে!
.
২০.
ঘণ্টা দেড়েক বাদেই আবার নির্মলশিব হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরে এল আমাদের ফ্ল্যাটে।
কি হল, দিয়েছেন মেসেজ পাঠিয়ে?
হ্যাঁ, প্লেন এতক্ষণে বোধ হয় পোঁছল কাবুল পোর্টে। কিন্তু কি আশ্চর্য সত্যি সত্যিই সুব্রতবাবু, যাকে বলে তাজ্জব বনে গিয়েছি। অ্যাঁ, সিগারেটের প্যাকেটের মধ্যে সোনা! এ যে রূপকথাকেও হার মানাল!
সত্যি, রূপকথার চাইতেও যে সময় সময় বিস্ময়কর কিছু ঘটে নির্মলশিববাবু!
কিন্তু তা যেন হল, এই উর্বশী সিগারেটের ব্যাপারটা আপনাকে সন্ধান দিল কে মিঃ রায়?
মৃদু হেসে কিরীটী বলে, কে আবার দেবে। ভগবান যে দুজোড়া চক্ষু কপালের ওপর জন্মের সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে দিয়েছেন সেই চক্ষুজোড়াই সন্ধান দিয়েছে। তা যেন হল,-আমাকে আর একটা যে কাজের ভার দিয়েছিলাম সেটার কতদূর করলেন?
কিসের? সেই হরগোবিন্দবাবুর কুকুর দুটোর কথা তো?
হ্যাঁ।
বললেন, তিনি কুকুর নিয়ে প্রস্তুত থাকবেন ঠিক সময়—কথা দিয়েছেন।
ঠিক আছে, তাহলে আপনাকে ঠিক যে জায়গায় থাকতে বলেছি সেইখানে সশস্ত্র একেবারে হাজির থাকবেন কাল রাত্রে যথাসময়ে।
কি আশ্চর্য! থাকব বৈকি!
তাহলে এবারে আসতে আজ্ঞা হোক।
কি আশ্চর্য! উঠতে বলছেন তাহলে? হ্যাঁ।
বেশ, বেশ। কি আশ্চর্য। তাহলে আমি চলি, কি বলেন?
হ্যাঁ।
নির্মলশিববাবু বিদায় নেবার পর কিরীটী বললে, সুব্রত, ঘরটা একটু পরিষ্কার করে রাখ।
কেন, কি ব্যাপার?
বলা তো যায় না, হঠাৎ ধর তোরই খোঁজে কোন ভদ্রমহিলার যদি এ ঘরে এই সময়ে আবির্ভাব ঘটে তিনি কি ভাববেন বল্ তো! ভাববেন হয়ত আমরা বুঝি কেবল দক্ষিণ হস্তে একটি ব্যাপারের সঙ্গেই পরিচিত। সেটা কি খুব শোভন হবে।
তা যেন বুঝলাম, কিন্তু আসছেন কে?
কে বলতে পারে-হয়ত চিত্রাঙ্গদা, নয়ত রাজনটী বসন্তসেনা, কিংবা স্বয়ং উর্বশীই এই ক্ষুদ্র ফ্ল্যাটে আবির্ভূতা হতে পারেন।
হেঁয়ালি রাখ। কথাটা খুলে বল্।
আমিই কি সঠিক জানি নাকি যে হেঁয়ালি ছেড়ে সঠিক বলব! সবটাই তো আমার অনুমান।
কিন্তু কিরীটীর অনুমান সেরাত্রে মিথ্যেই হল।
অথচ সেরাত্রে প্রতিটি মুহূর্ত যে কার অপেক্ষাতে কিরীটী অসীম আগ্রহে কাটিয়েছে, একমাত্র তা আমিই জানি।
এবং শেষ পর্যন্ত যতক্ষণ না রাত্রি প্রভাত হল কিরীটী শয্যায় গেল না।
জেগেই কাটিয়ে দিল রাতটা।
পরের দিনও সারাটা দিন কিরীটী ঘরে বসেই কাটিয়ে দিল।
কোথাও বের হল না।
কেবল চেয়ারটার উপরে চোখ বুজে বসে রইল।
কিন্তু বুঝতে পারছিলাম তার কান দুটো খাড়া হয়ে আছে।
এবং সে কারও আসারই প্রতীক্ষ্ণ করছে।
অবশেষে একসময় ক্রমশ বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা এল।
এবং ক্রমশ যতই সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হতে চলল কিরীটী একটা চাপা উত্তেজনায় যেন অস্থির হয়ে উঠতে লাগল।
এবং ব্যাপারটা যে আদৌ হেঁয়ালি নয় সেটাই যেন ক্রমশ আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল।
কিরীটী সত্যি সত্যিই কারও আগমন প্রতীক্ষ্ণয় ভিতরে ভিতরে অত্যন্ত অস্থির, অত্যন্ত চঞ্চল হয়ে উঠেছে গতকালের মতই।
কিন্তু কে?
কার আগমন প্রতীক্ষ্ণ করছে কিরীটী?
কার আগমন প্রতীক্ষ্ণয় কিরীটী এমন চঞ্চল হয়ে উঠেছে?
এমন উত্তেজিত হয়ে উঠেছে?
ইতিমধ্যে কিরীটী চেয়ার থেকে উঠে পায়চারি শুরু করেছিল।
আমি নির্বাক চেয়ারে বসে আর কিরীটী ঘরের মধ্যে পায়চারি করছে।
পায়চারি করছে দেখছি সে সমানে সেই বেলা তিনটে থেকে।
মধ্যে মধ্যে অস্থির ভাবে নিজের মাথার চুলে আঙুল চালাচ্ছে।
শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ একটানা কয়েক ঘণ্টার প্রতীক্ষ্ণর বুঝি অবসান হল রাত্রি সাড়ে নটায়।
ঘরের বন্ধ দরজায় অত্যন্ত মৃদু নক পড়ল।
সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু কিরীটী গিয়ে দরজা খুলে দিল।
আসুন—আপনার জন্যেই এতক্ষণ অপেক্ষা করছিলাম। আমি জানতাম আসবেন। ও কি, বাইরে দাঁড়িয়ে রইলেন কেন? ঘরের ভিতরে আসুন।
ঘরে এসে ঢুকল সীতা মৈত্র।
আমিও দরজার কাছে এগিয়ে গিয়েছিলাম।
কিরীটী দরজাটা বন্ধ করে দিল।
বসুন।
সীতা মৈত্র কিন্তু বসল না।
হাতের হ্যান্ডব্যাগ থেকে একখানা চিঠি বের করে কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদুকণ্ঠে বললে, আপনিই তাহলে এই চিঠি আমাকে পাঠিয়েছেন?
চিঠির নিচে তো আমার নামস্বাক্ষরই তার প্রমাণ দিচ্ছে সীতা দেবী!
কিন্তু আমি আপনার চিঠির কোন অর্থই তো বুঝতে পারলাম না মিঃ রায়!
মৃদু হেসে কিরীটী বললে, পেরেছেন বৈকি!
পেরেছি?
হ্যাঁ, পেরেছেন। নচেৎ আমার কাছে চিঠি পড়েই ছুটে আসতেন না।
কিন্তু—
বসুন ঐ চেয়ারটায়, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তো কথা হয় না।