প্লেটে খাবার সাজাত সাজাতে বললাম, একদা বাল্যকালে।
সে যুগের অর্জুনের মত এ যুগের সুভদ্রাটিকে নিয়ে পালা না কেন তুই।
বলতে বলতে উঠে এসে খাবারের প্লেটটা টেনে নিয়ে বসল কিরীটী।
হাসতে হাসতে বললাম, তা মন্দ বলিসনি, কিন্তু মুশকিল আছে যে একটা।
একটা মাছের ফ্রাই প্লেট থেকে তুলে নিয়ে বড় রকমের একটা কামড় দিয়ে আয়েস করে চিবুতে চিবুতে কিরীটী ভ্ৰ কুঁচকে নিঃশব্দে আমার মুখের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললে, কেন?
বললাম, সে যুগের হলধারী বলরাম যে এ যুগে রেঞ্চ হাতে ঘটোৎকচ হয়ে আবির্ভূত হয়েছেন!
দূর, দূর-ওটা একটা একের নম্বরের গবেট। ওকে তো কাবু করতে দু মিনিট সময়ও লাগে না। ওসব নিয়ে মনখারাপ করিস না, বুঝলি? বলে আর একটা ফ্রাই তুলে নিয়ে আরাম করে তার স্বাদগ্রহণ করতে করতে বললে, বুঝলি, বাবা বিশ্বনাথ বলে ঝুলে পড়।
ঝুলে পড়ব?
হুঁ। দিবারাত্রি ঐ শ্রীমুখপঙ্কজখানি চিন্তা করার চাইতে ঝুলে পড়াই তো বুদ্ধিমানের কাজ।
দরজার গায়ে ঐ সময় মৃদু তিনটি নক পড়ল।
দরজাটা খুলে দে, আমাদের কি আশ্চর্য নির্মলশিব এলেন!
সত্যি, নির্মলশিববাবুই।
কি আশ্চর্য! আপনার কথা শেষ পর্যন্ত একেবারে সেন্ট পারসেন্ট মিলে গেল মিঃ রায়!
একটা মাঝারি সাইজের প্যাকেট হাতে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে নির্মলশিব বললে।
আসুন নির্মলবাবু, বেশ গরম ফ্রাই আছে, খাবেন নাকি? কিরীটী ফ্রাই-সমেত টিফিনক্যারিয়ারের বাটিটা নির্মলশিবের দিকে এগিয়ে দিল।
হঠাৎ তার অত্যধিক উৎসাহ ও উত্তেজনার মুখে কিরীটীর ঐ রকম নিরাসক্তভাবে ফ্রাইয়ের বাটি এগিয়ে দেওয়ায় ভদ্রলোক যেন কেমন একটু থতমত খেয়ে যায়।
হাতের প্যাকেটটা হাতেই থাকে, কেমন যেন বোকার মতই প্রশ্ন করে। বলে, ফ্রাই।
হ্যাঁ, অতি উপাদেয় ভেটকি মাছের ফ্রাই। খেয়েই দেখুন না!
বলতে বলতে কিরীটী নিজেই আর একটা ফ্রাই বাটি থেকে তুলে নিল।
কিন্তু মিঃ রায়–
কি, বলুন? বামাল তো পেয়েছেন আর কেমন করে পাচার হয় তারও হদিস পেয়েছেন!
তা—তা পেয়েছি বটে, তবে–
কারবারীদের সন্ধান পাননি, এই তো? মা ভৈষী—যজ্ঞের যখন পেয়েছেন, হোতার সন্ধান পাবেন বৈকি!
কিন্তু বামালেরই বা সন্ধান পেলাম কোথায়?
পাননি?
কই, সবই তো উর্বশী সিগারেটের প্যাকেট! বলতে বলতে হাতের প্যাকেটটা সামনের টেবিলের উপরে নামিয়ে রেখে নির্মলশিব হতাশায় একেবারে ভেঙে পড়ল সত্যি সত্যিই, দেখুন না উর্বশী সিগারেট।
প্যাকেকটা সঙ্গে সঙ্গে আমি প্রায় টেবিল থেকে তুলে নিয়েছিলাম।
সত্যিই উর্বশী সিগারটের লেবেল আঁটা একটা মাঝারি আকারের সাধারণ প্যাকিং পেপারে প্যাক-করা প্যাকেট।
আমি প্যাকেটটা খুলতে শুরু করেছি ততক্ষণে।
কিরীটী মৃদু হেসে বলল, আপনি মশাই অত্যন্ত অবিশ্বাসী। বিশ্বাস না থাকলে কি কৃষ্ণ মেলে? ঐ দেখুন সুব্রতকে, জহুরী ঠিক জহর চিনেছে, ইতিমধ্যেই প্যাকেটটা খুলতে শুরু করেছে।
উপর থেকে সাধারণ সিগারেটের প্যাকেট মনে হলেও—যত্ন নিয়ে প্যাকেটটা বাঁধা হয়েছে।
এবং প্যাকেটটা খুলতেই চোখের সামনে বের হল আমাদের পর পর সাজানো যত্ন করে সব ছোট ছোট সিগারটের প্যাকেট।
আমি প্যাকেটগুলো সব এক এক করে টেবিলের উপরে নামালাম। সবই সিগারেটের প্যাকেট-মধ্যে তার অন্য কিছু নেই।
সিগারেটের প্যাকেটগুলো দেখে নির্মলশিবের মুখে হতাশার চিহ্ন ফুটে উঠেছিলই, আমারও মুখে বোধ হয় কিছুটা প্রকাশ পেয়েছিল।
কিরীটী কিন্তু নির্বিকার।
মৃদু হেসে বললে, কি, পরশপাথর মিলল না?
এবং কথাটা বলতে বলতেই সহসা হাত বাড়িয়ে একটা প্যাকেট তুলে নিয়ে সেটা খুলে ফেলল।
খোলা প্যাকেটের সমস্ত সিগারেট চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল।
কিরীটী পরমুহূর্তেই আর একটা প্যাকেট তুলে নিল। সেটা খুলতেও সিগারেট দেখা গেল সবই।
তবু কিন্তু নিরতিশয় উৎসাহের সঙ্গে একটার পর একটা প্যাকেট তুলে নিয়ে কিরীটী খুলে যেতে লাগল।
কিন্তু সিগারেট–শুধু সিগারেট।
ততক্ষণে কিরীটীরও মুখের হাসি বুঝি মুছে গিয়েছিল।
সে যেন পাগলের মতই সিগারেটের প্যাকেটগুলো একটার পর একটা খুলতে থাকে।
সিগারেটগুলো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
আমি আর নির্মলশিব নির্বাক।
কিরীটীর চোখ মুখ লাল হয়ে উঠেছে একটা চাপা উত্তেজনায়।
কঠিন ঋজু চাপাকণ্ঠে যেন কতকটা আত্মগতভাবেই বললে, না, ভুল হতে পারে। কিছুতেই না-বলতে বলতে হাতে যে প্যাকেকটা তখন তার ছিল সেটা খুলতেই চকচকে একটা লম্বা চাবির মত কি বের হয়ে পড়ল। সাইজে সেটা দু ইঞ্চি প্রায় লম্বা হবে।
পেয়েছি, এই যে পেয়েছি! ভুল হতে পারে? ভুল হয়নি আমার—এই যে দেখুন!
উত্তেজনায় ততক্ষণে আমি ও নির্মলশিববাবু কিরীটীর হাতের দিকে ঝুঁকে পড়েছি।
কি আশ্চর্য! এ যে সত্যি সত্যিই–
নির্মলশিবের অর্ধসমাপ্ত কথাটা কিরীটীই শেষ করল, হ্যাঁ, সোনার চাবি। ওজন অন্তত তিন থেকে চার ভরি তো হবেই।
কি আশ্চর্য! দেখি, দেখি, মিঃ রায়, দেখি–সোনার চাবিটা সাগ্রহে কৌতূহলে হাতে তুলে নিল নির্মলশিববাবু?
কিরীটী কথা বললে আবার, আজকের প্লেনে কতগুলো বাক্স যাচ্ছিল নির্মলশিববাবু?
দশটা বাক্স।
দশটা বাক্স! এক-একটা বাক্স কতকগুলো করে প্যাকেট রয়েছে নিশ্চয়ই গুনে দেখেছেন?
দেখেছি বইকি, কুড়িটা করে প্যাকেট।
কুড়িটা। তাহলে কুড়ি ইনটু দশ—দুশো প্যাকেট, অর্থাৎ তাহলে হল দুশো ইনটু চার অর্থাৎ আটশো ভরি সোনা আজ পাচার হচ্ছিল এ দেশ থেকে!