এসে দেখি ঘরের দরজা বন্ধ।
সঙ্গে ড়ুপলিকেট ইয়েল লকের চাবি ছিল, চাবি দিয়ে ঘর খুলে ভিতরে প্রবেশ করলাম।
কিরীটী তখন ঘরে নেই, কোথাও বের হয়েছে নিশ্চয়ই। ফ্যানটা চালিয়ে দিয়ে চেয়ারটার উপর গা ঢেলে দিলাম।
এবং এতক্ষণে যেন নিরিবিলিতে একাকী সকালবেলাকার ব্যাপারটা আদ্যোপান্ত মনেমনে ভাববার অবকাশ পেলাম।
কিরীটী কেন আমাকে পাঠিয়েছিল লাটুবাবুর গ্যারেজের আসল মালিকের অনুসন্ধান করতে?
আসল মালিকের নামটার কি সত্যিই কোন প্রয়োজন ছিল কিরীটীর? তবে কি কিরীটীর সেই শেষ ও আসল ঘাঁটিটিই ঐ লাটুবাবুর গ্যারাজটা? কিন্তু কথাটা যেন মন কিছুতেই মেনে নেয় না। তাছাড়া ঐ ঘটোৎকচ?
সেরাত্রে সীতা মৈত্রের ঘরে যে পুরুষের কণ্ঠস্বর শুনেছিলাম সে ঘটোৎকচের গলা নয়।
অথচ ঘটোৎকচ বললে তারই নাম পিয়ারীলাল। মিথ্যা বলেছে বলে মনে হয় না।
লোকটাকে আর একটু বাজিয়ে দেখতে পারলে হত।
আরও একটা কথা—কথা বলতে বলতে হঠাৎ ঘটোৎকচের গলার স্বর যখন বদলে গেল তখন বোঝাই যাচ্ছে আমাকে সে সন্দেহ করছে বা সন্দেহের চোখে দেখেছে।
কিন্তু হঠাৎ আমার প্রতি তার মনে সন্দেহই বা জাগল কেন? আর কি করেই বা জাগল?
একদিন মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য ওভারসিজ লিঙ্কের সেক্রেটারি দিদিমণি সীতা মৈত্রের ঘরে সে আমাকে দেখেছে।
তাও ঐ সময় সে আর্থার হ্যামিলটনকে নিয়েই ব্যস্ত ছিল, আমার দিকে নিশ্চয়ই ভাল করে নজর দেবারও তার অবকাশ হয়নি।
ঐটুকু সময়ের জন্য দেখেই সে আমাকে চিনে রেখেছে, নিশ্চয়ই তা সম্ভব নয়।
আর চিনেই যদি থাকে তো প্রথম থেকেই বা সেটা প্রকাশ করেনি কেন তার কথায়বার্তায় ও ব্যবহারে?
কিরীটীর ধারণা, গতরাত্রে সীতা মৈত্রের ঘরে ঐ ঘটোৎকচ বা পিয়ারীলালই এসেছিল। সীতা মৈত্রের সঙ্গে ঘটোৎকচের একটা সম্পর্ক আছে।
কিন্তু সে সম্পর্কটা কতখানি?
ঘটোৎকচের সঙ্গে সীতা মৈত্রের সম্পর্কের কথাটা চিন্তা করতে গিয়ে কখন যে সীতা মৈত্ৰই মনটা জুড়ে বসেছে, বুঝতে পারিনি।
কিরীটী মিথ্যা বলেনি, সত্যিই মেয়েটির অদ্ভুত যেন একটা আকর্ষণ আছে।
এমন এক-একখানি মুখ আছে যা একবার চোখে পড়লে মনের মধ্যে এমন ভাবে একটা দাগ কেটে বসে যা কখনও বুঝি মুছে যায় না।
সীতা মৈত্রের মুখখানি তেমনি করেই যেন মনের মধ্যে দাগ কেটে বসে গিয়েছিল।
বার বার কেবলই একটা কথা ঘুরেফিরে মনে হচ্ছিল, সীতা মৈত্র যেন ওদের দলের নয়।
ওদের দলে সীতা মৈত্র একান্তভাবেই বেমানান যেন।
সত্যি দুর্ভাগ্য আর্থার হ্যামিলটনের, সীতা মৈত্রের মত স্ত্রী পেয়েও আজ সে ছন্নছাড়া, এক পাপচক্রের মধ্যে হাবুড়ুবু খাচ্ছে!
সীতা মৈত্রের মত স্ত্রী পেয়েও আজ তার ঘরে নেই কেন? জীবনে কেন শান্তি নেই? কেন তাকে মদ খেয়ে নিজেকে ভোলবার চেষ্টা করতে হয়?
তার কেনই বা তাকে সেই নেশার খরচ যোগবার জন্য আজ অন্যের কাছে ভিক্ষুকের মত হাত পাততে হয়?
রাজার ঐশ্বর্য পেয়েও আজ কেন সে ভিক্ষুকেরও অধম?
যে ভালবাসা দিয়ে একদিন সে সমস্ত পৃথিবীকে অধিকার করতে পারত, আজ সেই ভালবাসা পেয়েও কেন তাকে অমন করে হারাতে হল?
আর কেনই বা সে অমন ভাল চাকরিটা ছেড়ে দিল?
সীতা মৈত্রের কথা ভাবতে ভাবতে কখন একসময় বুঝি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, কিরীটীর ডাকে ঘুম ভেঙে গেল।
কি রে সুব্রত, ঘুমে যে একেবারে কুম্ভকর্ণকেও হার মানালি!
কখন এলি?
এই তো ফিরছি। কিন্তু ব্যাপার কি বল তো? কাল রাত্রে ঘুম হয়নি নাকি?
সে কথার জবাব না দিয়ে প্রশ্ন করলাম, কোথায় গিয়েছিলি?
বিশেষ কোথাও না। তারপর-পিয়ারীলালের সঙ্গে আলাপ হল?
হল আর কই!
কেন?
তাড়িয়ে দিল যে আলাপটা ঠিক জমে ওঠবার মুখেই।
কি রকম?
সংক্ষেপে সকালবেলার ঘটনাটা খুলে বললাম।
সব শুনে কিরীটী শুধু বলল, হুঁ।
কিন্তু আমাকে সন্দেহ করল কি করে তাই ভাবছি!
কিরীটী কিন্তু আমার কথার ধার দিয়েও গেল না।
সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল সে। বললে, একটা জরুরি কাজ একদম ভুলে এসেছি সুব্রত। সে কাজটা এখুনি একবার বের হয়ে গিয়ে তোকে সেরে আসতে হবে।
কি কাজ?
রমেশ মিত্র রোডে আমার বন্ধু সন্তোষ রায় থাকে, সেখানে গিয়ে ফোন করে কৃষ্ণাকে একটা কথা বলবি–
বল।
কাল রাত সাড়ে বারোটা থেকে একটার মধ্যে হীরা সিং যেন আমার পাশের বাড়িতেই যে অ্যাডভোকেট সুহাস চৌধুরী থাকেন তার গাড়িটা নিয়ে যোধপুর ক্লাবের মাঠের কাছে আমাদের জন্য অপেক্ষা করে। কৃষ্ণা গিয়ে যেন সুহাসবাবুকে আমার কথা বলে গাড়িটা তার চেয়ে নেয়। হ্যাঁ, আর দেরি করিস না। আজ শনিবার, হাইকোর্ট বন্ধ বটে, তবে বেলা একটার মধ্যেই সুহাবাবু মাছ ধরতে একবার বের হয়ে গেলে আর তার গাড়িটা পাওয়া যাবে না। গাড়িটা ভাল, rough রাস্তায় dependable।
আমি আর দ্বিরুক্তি না করে উঠে পড়লাম।
.
১৯.
ফিরে এসে ঘরে ঢুকে দেখি চেয়ারটার উপরে নিশ্চিন্ত আরামের গা ঢেলে দিয়ে কিরীটী ঘুমোচ্ছে।
ইতিমধ্যে ভৃত্য টিফিন-ক্যারিয়ার করে টেবিলের উপরে আহার্য রেখে গিয়েছিল।
হাতঘড়িতে দেখলাম বেলা তখন সাড়ে বারোটো বেজে গিয়েছে। ক্ষুধায় পেটে যেন পাক দিচ্ছিল।
বাথরুমে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে এসে কিরীটীকে ডেকে তুললাম।
খাবি না?
কিরীটী উঠে বসে আলস্যের একটা হাই তুলতে তুলতে বললে, আচ্ছা সুব্রত, বেদব্যাস-রচিত মহাভারত তো পড়েছিস তুই নিশ্চয়ই?