একটা ভুষো কালির মত কালো কুচকুচে রঙ বিরাট ভুড়িওয়ালা লোক খালি গায়ে হাঁটুর উপরে কাপড় তুলে বিরাট উনুনের ধারে বসে বিরাট একটা কড়াইয়ে গরম জিলাপি ভাঁজছে।
সদ্যভাজা জিলাপির গন্ধটা কিন্তু বেশ লাগে।
এগিয়ে চললাম ভিতরের দিকে।
অনেকটা জায়গা নিয়ে বিরাট টিনের শেডের তলায় গ্যারাজ ও ওয়ার্কশপ। সবটা জায়গাই অবিশ্যি টিনের শেড দেওয়া নয়, উন্মুক্ত জায়গা অনেকটা রয়েছে।
বিশেষ কোন লোকজন সামনাসামনি চোখে পড়ল না।
কেবল দেখলাম একটা রোগা ডিগড়িগে লম্বা শিখ দাঁতনের একটা কাঠি দিয়ে দাঁতন করছে আর অদূরের কলতলায় কে একটা লোক সাবান দিয়ে মাথা ঘষছে।
এদিক ওদিক আট-দশটা ট্রাক, বাস ও ট্যাকশি দাঁড়িয়ে রয়েছে উন্মুক্ত জায়গাটায়।
টিনের শেডটার মধ্যে উঁকি দিলাম। সেখানেও বাস, ট্রাক, প্রাইভেট কার অনেকগুলোই আছে।
বাতাসে একটা মোবিল ও পেট্রোলের গন্ধ।
এ গেঁড়াইয়া, গাল শুন!
কে যে কাকে সম্বোধন করল।
কে কাকে সম্বোধন করল জানবার জন্য এদিক ওদিক তাকাচ্ছি, হঠাৎ গ্যারাজের মধ্যে একটা পার্টিশনের ভিতর থেকে বের হয়ে এল ঘটোৎকচ, পরিধানে স্ট্রাইপ দেওয়া ময়লা পায়জামা, গায়ে একটা গেঞ্জি, সদ্য সদ্য বোধ হয় ঘুম ভেঙেছে।
একেই প্রথম দিন ওভারসিজ লিঙ্কের সেক্রেটারি দিদিমণির অফিস-ঘরে কয়েক মুহূর্তের জন্য দেখেছিলাম।
ঘটোৎকচও পার্টিশান থেকে বের হয়েই আমাকে সামনে দেখে বুঝি মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ায়।
রোমশ জোড়া ভ্র-দুটো যেন একটু কুঞ্চিত হয়েই পরক্ষণে আবার সরল হয়ে আসে।
কাকে চান? ঘটোৎকচ প্রশ্ন করে আমাকে।
মুহূর্ত না ভেবেই জবাব দিলাম, মিঃ পিয়ারীলালের সঙ্গে দেখা করতে চাই।
ভ্রূ-যুগল আবার মুহূর্তের জন্য কুঞ্চিত হল এবং আবার সরল হল।
ধূর্ত শিয়ালের মত চোখের দৃষ্টিটা এক লহমার জন্য বোধ হয় আমার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে নিল একবার।
কেন, পিয়ারীলালকে দিয়ে কি হবে?
দরকার ছিল আমার একটু–
আমিই পিয়ারীলাল।
আপনি পিয়ারীলাল? নমস্কার। আপনিই মোটর মেকানিক পিয়ারীরাল?
হ্যাঁ।
ঠিক ঐ সময়ে টিনের শেডের মধ্যে পুর্ব কোণে নজর পড়ল, উর্বশী সিগারেটের ভ্যানটা দাঁড়িয়ে রয়েছে।
কিন্তু বাঁদিকে যেন নজরই পড়েনি এমনিভাবে ঘটোৎকচের মুখের দিকে আবার তাকিয়ে বললাম, আপনি কি এই গ্যারাজ-ওয়ার্কশপের মালিক?
ঐ সময় একটা ছোকরা এসে পিয়ারীলালের সামনে দাঁড়িয়ে বললে, চা দেব?
হুঁ, ঘরে দে।
ছোকরাটা চলে গেল।
অ্যাঁ, কি বলছিলেন, মালিক? তা বলতে পারেন বৈকি, আমি-আমি ছাড়া আর মালিক কে? কিন্তু কি দরকার আপনার এই গ্যারাজের মালিক কে জেনে?
কথাটা তাহলে আপনাকে খুলেই বলি মিঃ পিয়ারীলাল। আমার একটা বড় করে বেশ গ্যারাজ ও মোটর রিপেয়ারিং শপ খুলবার ইচ্ছা আছে। উল্টোডাঙ্গার ওদিকে একটা জায়গাও লিজ নিয়েছি।
কথাটা বলায় দেখলাম কাজ হল।
পিয়ারীলালের ভ্রূ-যুগল কুঞ্চিত হয়ে আবার সরল হল।
আবার একবার যেন নতুন করে পিয়ারীলাল আমার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করল।
আবার বললাম, তাই বড় বড় মোটর রিপেয়ারিং শপগুলো আমি ঘুরে ঘুরে যথাসম্ভব দশ দিক জানবার চেষ্টা করছি। আপনারা তো অভিজ্ঞ লোক, আপনাদের পরামর্শ মূল্যবান।
তা কি রকম ক্যাপিটাল নিয়ে নামছেন?
খুব বেশি নয়, হাজার পঞ্চাশ-ষাট। রিপেয়ারিং তো হবেই আমার কারখানায়, সঙ্গে বড়ি-বিলডিং, ছোটখাটো একটা লেদ মেশিন আর স্প্রে পেনটিংয়ের ব্যবস্থাও থাকবে। আপনি কি বলেন, সেটাই বিবেচনার কাজ হবে না কি? তবে যাই করি, ভাল একআধজন মেকানিক না হলে তো আর কারখানা চালানো যাবে না। আচ্ছা সেরকম ভাল কোন মেকানিক আপনার খোঁজে আছে মিঃ পিয়ারীলাল?
না।
হঠাৎ পিয়ারীলালের কণ্ঠস্বরে যেন আমার কেমন খটকা লাগল।
নিজের অজ্ঞাতেই চমকে ওর মুখের দিকে তাকাই।
এখানে কোন্ সুবিধা হবে না। আপনি রাস্তা দেখুন!
কথাটা বলে পিয়ারীলাল আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না, সটান পার্টিশনের মধ্যে গিয়ে ঢুকল।
.
১৮.
বলাই বাহুল্য আমিও আর অতঃপর সেখানে দাঁড়াই না।
অবিলম্বে স্থানত্যাগ করাই সমীচীন মনে হওয়ায় আমি গ্যারাজ থেকে সোজা বের হয়ে এলাম।
কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ফ্ল্যাটে গেলাম না।
বড় রাস্তা পার হয়ে সোজা দক্ষিণমুখে হাঁটতে শুরু করলাম।
কিন্তু কিছুদূর হাঁটবার পরই মনটা কেমন সন্দিগ্ধ হওয়ায় পিছন ফিরে তাকালাম, কেউ অনুসরণ করছে না তো!
পশ্চাতে যারা ছিল তাদের মধ্যে তেলকালি-মাখা একটা নীলরঙের হাফপ্যান্ট ও হাওয়াই শার্ট পরিধানে রোগা লোককে দেখতে পেলাম।
সেই লোকটার সঙ্গে আমার ব্যবধান মাত্র হাত দশেক। কেন যেন মনে হল, লোকটা আমারই পিছু পিছু আসছে! যাই হোক, আবার সামনের দিকেই চলতে শুরু করলাম। কিন্তু মনের মধ্যে সন্দেহ জেগেছে, আবার কিছুদূর গিয়ে ফিরে তাকালাম। ঠিক সেই ব্যবধানেই পূর্বের লোকটিকে পশ্চাতে দেখতে পেলাম।
অতঃপর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েই রইলাম। লক্ষ্য করলাম, লোকটিও দাঁড়িয়ে রয়েছে। আবার চলা শুরু করতেই সেও দেখি চলতে শুরু করেছে।
আর কোন সন্দেহ রইল না। বুঝলাম লোকটা সত্যিই আমাকে অনুসরণ করছে।
মনে মনে হেসে একটা ট্যাকশির সন্ধানে এদিক ওদিক তাকাতেই একটা খালি ট্যাকশি পাওয়া গেল।
অতঃপর প্রায় ঘণ্টা দুই এদিক ওদিক ঘুরে পূর্বোক্ত ফ্ল্যাটে যখন ফিরে এলাম বেলা তখন প্রায় সোয়া এগারোটা।