হ্যাঁ। নমস্কার। চিনতে পেরেছেন তাহলে!
চিনব না মানে? কি আশ্চর্য! বলেই হাঃ হাঃ করে হেসে ওঠে নির্মলশিব সাহেব।
বসুন নির্মলশিববাবু। কিরীটী এবার বলে।
কি আশ্চর্য! বসব না? আরে বসবার জন্যেই তো আসা। আর আজ যতক্ষণ না হ্যাঁ বলবেন উঠব না—একেবার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েই এসেছি।
কথাগুলো বলতে বলতে জাঁকিয়ে বসে নির্মলশিব এবং কথা শেষ করে বলে, এই বসলাম।
কি ব্যাপার বলুন তো নির্মলশিববাবু? এবার আমিই প্রশ্ন করি।
কি আশ্চর্য! কিছুই জানেন না সত্যি বলছেন আপনি?
সত্যিই জানি না।
কি আশ্চর্য! আরে মশাই সে এক বিশ্রী নাজেহালের ব্যাপার! বুঝলেন সুব্রতবাবু, গোল্ড একেবারে যাকে বলে সত্যি সত্যি pure gold মশাই!
গোল্ড?
হ্যাঁ, হ্যাঁ—সোনা, খাঁটি সোনা এন্তার স্মাগল করছে।
.
০২.
নির্মলশিববাবুর মুখে গোল্ড এবং সেই গোল্ড স্মাগল-কথা দুটি শুনেই বুঝেছিলাম তার বক্তব্যটা কোন পথে এগুচ্ছে।
এখন আরও স্পষ্ট হল। নির্মলশিববাবু আবার বলতে শুরু করে, কিছুই খবর রাখেন না দেখছি!
মৃদু হেসে বললাম, আদার ব্যাপারী আমি। ওসব সোনাদানার ব্যাপার—কিন্তু কিরীটীর শরণাপন্ন হয়েছেন যখন–
সাধে কি আর হয়েছি মশাই! আমি তো ছাড়, সরকারের এনফোর্সমেন্ট ব্রাঞ্চ, কাস্টমস এবং স্পেশাল ব্রাঞ্চ সকলের চোখে ধুলো দিয়ে স্রেফ যাকে বলে সকলকে একেবারে গত কয়েক মাস ধরে বুদু বানিয়ে ছেড়ে দিল।
বুদ্ধু?
তা না হলে আর বলছি কি। স্রেফ বুদ্ধু!
তা কোন হদিসই করতে পারলেন না এখনও?
কি আশ্চর্য! কি বললাম তবে?
তা যেন হল, কিন্তু ব্যাপারটা হঠাৎ কেমন করে আপনাদের নজরে এসে পড়ল। —অর্থাৎ বলছিলাম, ব্যাপারটা টের পেলেন কি করে? শুধালাম।
কিরীটী কিন্তু একান্ত নির্বিকার ভাবে তখন পাইপ টেনেই চলেছে সোফায় হেলান দিয়ে দুটি চক্ষু বুজে।
কিন্তু যতই সে চক্ষু দুটি মুদ্রিত করে থাকুক না কেন, স্পষ্টই বুঝতে পারছিলাম তার ঐ নিষ্ক্রিয়তা আদৌ নিষ্ক্রিয়তা নয়, রীতিমতই যাকে বলে তার শ্রবণেন্দ্রিয় দুটি জাগ্রত হয়ে রয়েছে।
অনাগ্রহের ভাবটা তার ভান মাত্রই।
কি আশ্চর্য! সেও এক অদ্ভুত ব্যাপার! আবার কথা বলে নির্মলশিব।
কি রকম? শুধালাম।
একটা চিঠি—
চিঠি?
হ্যাঁ। একটা বেনামা চিঠি পেয়ে কর্তাদের সব টনক নড়ে উঠেছে। তাঁদের টনক নড়েছে—আর প্রাণান্ত হচ্ছে আমাদের।
তা সে বেনাম চিঠিটা আপনি দেখেছেন?
তা আর দেখিনি! কি আশ্চর্য! কি যে বলেন?
কি লেখা ছিল চিঠিতে?
কি আশ্চর্য! মুখস্থ করে নিয়েছি চিঠিটা, আর কি লেখা ছিল তা মনে থাকবে না? শুনুন, লিখেছে, মাননীয় কমিশনার বাহাদুরের সমীপেষু—ভেবে দেখুন একবার সুব্রতবাবু, ইয়ার্কির মাত্রাটা। কমিশনার বাহাদুরের সমীপেষু, কেন রে বাপু, পাকামি করতে কে বলেছিল, জানাতে যদি হয় তো আগে আমাদের জানালেই হত!
তা তো নিশ্চয়ই।
তবেই বুঝুন! পাকামি ছাড়া কি আর বলুন তো!
কিন্তু চিঠিতে কি লেখা ছিল যেন বলছিলেন—
হ্যাঁ, সেই কথাই তো বলছি, লিখেছে, আপনি কি খবর রাখেন, স্বাধীন ভারত থেকে একদল চোরাকারবারী কত সোনা গত এক বছর ধরে পাকিস্তানের ভিতর দিয়ে আমেরিকায় চালান করে দিয়েছে আর আজও দিচ্ছে? এখনও যদি ঐভাবে সোনার চোরাই রপ্তানিতে বাধা না দিতে পারেন তো জানবেন, আর দুএক বছরের মধ্যে এক তোলা বাড়তি সোনাও এ দেশে আর থাকবে না।
বলেন কি, সত্যি?
কি আশ্চর্য! সত্যি মানে, চিঠিতে তো তাই লিখেছে—
লিখেছে বটে, তবে–
তবে কি?
মানে উড়ো চিঠি তো!
মানে?
মানে বলছিলাম, এমনও তো হওয়া অসম্ভব নয় যে আপনাদের খানিকটা নাজেহাল করার জন্যই কোন দুষ্ট প্রকৃতির লোক ঐ উড়ো চিঠিটা দিয়েছে।
হুঁ, আপনি বুঝি তাই ভাবছেন সুব্রতবাবু?
মানে বলছিলাম, ব্যাপারটা খুব একটা অসম্ভব কি?
আরে মশাই, না না—সোনাদানার ব্যাপার, ও ঠিকই—তাছাড়া—
তাছাড়া?
গত বছর-দুই ধরে কতকগুলো খবরও যে আমরা পেয়েছি সোনা স্মাগলিংয়ের ব্যাপারে! তারপর ঐ চিঠি
কিরীটী এতক্ষণ চুপচাপই ছিল।
আমাদের কথার মধ্যে কোন মন্তব্য করেনি।
হঠাৎ ঐ সময় কিরীটী কথা বললে। প্রশ্ন করল, নির্মলশিববাবু!
আজ্ঞে?
বলছিলাম, কিরীটী বললে, চিঠিটা আপনারা কিভাবে পেয়েছিলেন নির্মলশিববাবু? হাতে, না ডাক মারফত?
কি আশ্চর্য! ওসব চিঠি বেনামা—উড়ো ব্যাপার, ডাক মারফতই চলে জানবেন চিরদিন।
চিঠিটা হাতে লেখা, না টাইপ করা? পুনরায় প্রশ্ন করে কিরীটী।
টাইপ করা।
খামে, না পোস্টকার্ডে?
খামে।
খামের ওপর ডাকঘরের ছাপটা দেখেছিলেন?
কি আশ্চর্য! বিলক্ষণ, তা আর দেখিনি? ভবানীপুরের পোস্ট অফিসের ছাপ মারা ছিল খামটার গায়ে।
ভবানীপুর ডাকঘরের?
হুঁ।
কিরীটী তারপর চোখ বুজে যেন কি ভাবে।
তারপর একসময় চোখ খুলে বলল, চিঠিটা আপনারা যা ভাবছেন, সত্যিই যদি তাই হয়, তাহলে তো–
কি?
তাহলে তো এক দিক দিয়ে আপনারা নিশ্চিন্তই হতে পারেন!
নিশ্চিন্ত হতে পারি?
হুঁ।
কি রকম?
হ্যাঁ, ধরে নিই যদি ব্যাপারটা সত্যিই, তাতে করে আপনাদের চিন্তার কি আছে এত?
কি আশ্চর্য! চিন্তার ব্যাপার নেই মানে?
নিশ্চয়ই। ভাঙনের মুখে আর কতদিন বাঁধ দিয়ে রোধ করবেন।
কি বলছেন?
ঠিক বলছি। বুঝতে পারছেন না, দলে ভাঙন ধরেছে! দলের কেউ মীরজাফরের রোল নিয়েছে এ নাটকে। অতএব নিশ্চিন্ত থাকুন, পলাশীর যুদ্ধ একটা শীঘ্রই হবে এবং হতভাগ্য সিরাজের পতন অবশ্যম্ভাবী!