বেশ। কিন্তু একটা কথা তোকে জিজ্ঞাসা করব ভাবছিলাম কিরীটী!
কি?
এটা অবশ্য বুঝতে পেরেছি যে সীতা মৈত্র আমাদের ঠিক পাশের ফ্ল্যাটেই থাকে, কিন্তু সেজন্যই কি–
কি?
তুই এখানে এসে উঠেছিস?
হ্যাঁ, এবং সেই সংবাদটা পেয়েই বাজোরিয়াকে যখন সেদিন ফোনে বলেছিলাম এই বাড়িতে আমাকে একটা ফ্ল্যাট যোগাড় করে দিতে তখন ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি ঘটনাচক্রে ঠিক সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় তার পাশের এই ফ্ল্যাটটাই খালি হয়ে যাবে। অনেক সময় পৃথিবীতে অনেক বিচিত্র যোগাযোগ ঘটে, এ ব্যাপারেও ঠিক তাই হয়েছে।
তোর কি ধারণা সোনার চোরাকারবারীদের সঙ্গে ঐ সীতা মৈত্র ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত?
জড়িত কিনা এখনও সঠিক বুঝে উঠতে পারিনি, তবে—
কি?
সীতা মৈত্রের যৌবন ও রূপ কোনটাই তো অস্বীকার করবার নয়!
অর্থাৎ–
অর্থাৎ এমনও হতে পারে, সীতা মৈত্রের রূপ ও যৌবন দুটোই শাণিত দুটি তরবারির মত মোক্ষম অস্ত্র হয়েছে ওদের হাতে।
আমারও তাই মনে হচ্ছিল কদিন থেকে। তবে একটা কথা আমি বুঝতে পারছি না—
কি? কিরীটী সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে তাকাল।
আর্থার হ্যামিলটনের সঙ্গে সীতা মৈত্রের বর্তমান সম্পর্কটা কি?
কি আবার, পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে একদা স্ত্রী ও স্বামী ছিল। কোন কারণে বিচ্ছেদ ঘটেছে।
কারণটা কি আমাদের ঘটোৎকচ?
কিরীটী হেসে ওঠে।
বললাম, হাসলি যে?
কারণ তোর অনুমান যদি সত্যিই হয় তো বলব সীতা মৈত্রের রুচি নেই। কিন্তু মা ভৈষী! তা নয় বন্ধু, তুই নিশ্চিন্ত থাকতে পারিস। কিন্তু রাত অনেক হল, একবার একটু নিদ্রাদেবীর আরাধনা করলে মন্দ হত না।
কথাটা বলে সত্যি সত্যিই দেখলাম কিরীটী শয়নের জন্য প্রস্তুত হতে লাগল।
কিরীটী!
কি?
পাশের ঘরে একটু আগে যারা কথা বলছিল তাদের মধ্যে একজনকে চিনতে পারলাম-সীতা মৈত্র, কিন্তু পুরুষের কণ্ঠস্বরটা কার বুঝতে পারলাম না তো!
কিরীটী ততক্ষণে শয্যায় আশ্রয় নিয়েছে।
একটা হাই তুলতে তুলতে বললে, পিয়ারীলাল।
পিয়ারীলাল! সে আবার কে?
লাটুবাবুর গ্যারাজের একজন মোটর মেকানিক। কিন্তু তোর ব্যাপার কি বল্ তো? তোর চোখে কি ঘুম নেই? আমার কিন্তু ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে!
কথাগুলো বলার সঙ্গে সঙ্গে কিরীটী পাশ ফিরে শুল।
কিন্তু আমার চোখে সত্যিই তখন ঘুম ছিল না।
কয়েকটা মুখ আমার মনের পাতায় পর পর ভেসে উঠতে লাগল একের পর এক।
ঘটোৎকচ, সীতা মৈত্র, চিরঞ্জীব কাঞ্জিলাল, ভিখারী সাহেব এবং আর্থার হ্যামিলটন। ঐ মুখগুলোর সঙ্গে নিজের অজ্ঞাতে যেন আর একখানি মুখ ভাববার চেষ্টা করতে লাগলাম, যাকে ইতিপূর্বে আমি না দেখলেও কিরীটী নিশ্চয়ই দেখেছে, নচেৎ ও জানল কি করে যে নাম তার পিয়ারীলাল?
লাটুবাবার কারখানার একজন মোটর মেকানিক পিয়ারীলাল। তা হোক, কিন্তু তার সঙ্গে সীতা মৈত্রের কি সম্পর্ক? আর ঘনিষ্ঠতাই বা লোকটার সঙ্গে তার কোন সূত্রে?
এবং কে-ই বা সেই নিরীহ ইডিয়ট প্রকৃতির লোকটা যার প্রতি এখনও সীতা মৈত্রের পুরনো প্রেম বুকের মধ্যে জমানো রয়েছে, যে প্রেমের জন্য মোটর মেকানিক পিয়ারীলালের বুকে ঈর্ষাটা টনটনিয়ে উঠে রক্তনখর বিস্তার করেছে?
অন্ধকার ঘরে শুয়ে পিয়ারীলাল আর সীতা মৈত্রের কথাই ভাবছিলাম।
পিয়ারীলালের কণ্ঠস্বরে সেই ঈর্ষার সুরটুকু আমার কানকে এড়িয়ে যায়নি। কেবলমাত্র ইডিয়েট ওসব জেনে ফেলছে বলেই নয়, সীতা মৈত্রের বুকের মধ্যে আজও তার জন্য ভালবাসা রয়েছে বলেই এ দুনিয়া থেকে সরে যেতে হবে আজ তাকে— পিয়ারীলাল তাই চায়।
আর যেতে তো হবেই-এই যে চিরাচরিত নীতি!
এক আয়েষার ভাগ্যাকাশে তো দুটি চন্দ্র থাকতে পারে না-ওসমান ও বীরেন্দ্র সিংহ!
ইডিয়ট ও মোটর মেকানিক পিয়ারীলাল!
কিন্তু কে ঐ ইডিয়ট?
আর সত্যিই যদি সে ইডিয়ট হত, সীতা মৈত্রের মত মেয়ের সেই ইডিয়টটার উপর দুর্বলতা থাকে কি করে?
পিয়ারীলাল এক কথার মানুষ, সে তার কণ্ঠস্বরেই বোঝা গিয়েছে।
ইডিয়টটার আজ প্রাণসংশয় হয়ে উঠেছে নিঃসন্দেহে। তাকে আজ এ দুনিয়া থেকে চলে যেতে হবেই।
শুধু স্বর্ণসন্ধানীদের রহস্য কিছুটা জেনে ফেলেছে বলেই নয়, পিয়ারীলালের প্রতিদ্বন্দ্বী আজ সে।
হায় রে বিচিত্র মানুষের মন, ভালবেসেও মুক্তি নেই, ভালবাসা পেয়েও মুক্তি নেই।
পঞ্চশরের দুমুখো শর।
কিন্তু ইডিয়ট–ইডিয়টটা কে? তবে কি–
হঠাৎ বিদ্যুৎ-চমকের মতই যেন নামটা মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মুখখানাও মনের পাতায় ভেসে উঠল—আর্থার হ্যামিলটন।
আর্থার হ্যামিলটনেকে সীতা মৈত্র তাহলে আজও ভুলতে পারেনি!
.
১৭.
পরেরদিন সকাল আটটা নাগাদ কিরীটীর পূর্বরাত্রের নির্দেশমত ঘর থেকে বের হলাম লাটুবাবুর গ্যারাজ ও ওয়ার্কশপের বর্তমান মালিকের অনুসন্ধানে।
আর মনের পাতায় যে অদেখা মানুষটার মুখটাকে তখনও কোন একটা পরিচিতের আকার দেবার চেষ্টা করছিলাম, সেই মোটর মেকানিক পিয়ারীলালের যদি সন্ধান পাই, দেখা পাই—সেই কথাটা ভাবতে ভাবতেই গেলাম।
তিনতলা ও চারতলা দুটো বাড়ির মাঝখান দিয়েই বলতে গেলে প্রায় গ্যারাজ ও ওয়ার্কশপে প্রবেশের কাচা অপ্রশস্ত রাস্তাটা।
বড় লরি বা বাস সে রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করতে পারবে বটে, তবে একটু অসাবধান হলেই দেওয়ালে ধাক্কা লাগার সম্ভাবনা।
ঢোকার মুখেই একটা হিন্দুস্থানীদের মিঠাইয়ের দোকান-লক্ষ্মীনারায়ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার।