রাস্তা থেকে বুঝবারও উপায় নেই যে বাড়িটার দক্ষিণদিকে অতখানি জায়গা নিয়ে একটা অমন বিরাট গাড়ি মেরামতের কারখানা রয়েছে।
পূর্ব, উত্তর ও পশ্চিম দিকে পর পর সব ফ্ল্যাট।
এক এক তলায় ছটি করে ফ্ল্যাট।
এক-একটি ফ্ল্যাটে তিনখানি করে ঘর—পরে জেনেছিলাম, বাথ ও কিচেন ছাড়া।
তিনদিকেই অর্থাৎ পূর্ব, উত্তর ও পশ্চিমে বারান্দা এবং বারান্দার গায়ে গায়ে ফ্ল্যাটগুলো।
সিঁড়িটা বরাবর পূর্ব-উত্তর কোণ দিয়ে উপরে উঠে গিয়েছে।
বারান্দায় দাঁড়ালে নিচের বাঁধানো আঙিনাটা দেখা যায়।
আঙিনার অর্ধেকটায় মোটা ও ভারী ত্রিপল খাটানো। দোতলা ও তিনতলার মত আঙিনার তিনদিকে নিচেও বারান্দা আছে।
নিচের তলায় উত্তর ও পশ্চিম দিকে গোটাচারেক যে ঘর ছিল সে ঘরগুলোও ওভারসিজ লিঙ্কের ভাড়া নেওয়া।
পরে অবিশ্যি জেনেছিলাম সে কথাটা।
অর্থাৎ বাইরে রাস্তা থেকে যে ওভারসিজ লিঙ্কের অফিস দেখা যায় সেটাই সবটা নয়, ভিতরেও অনেকটা অংশ জুড়ে তাদের কারবার।
.
৫ নং ফ্ল্যাটের ঘরের মধ্যে ঢুকে দেখি, আকারে ঘরটা বেশ বড়ই।
একদিকে দুটো খাট পাতা, খাটের উপরে সজ্জা বিছানো।
একধারে একটি টেবিল ও দেওয়াল-আলমারি।
ঘরের মাঝখানে একটা ক্যামবিসের আরামচেয়ারে বসে, সামনে ছোট একটা চতুষ্কোণ টুলের উপরে তাস বিছিয়ে কিরীটী বোধ হয় পেসেন্স খেলছিল।
আমাকে দরজা খুলে দিয়ে পুনরায় গিয়ে বসে পেসেন্স খেলার দিকে মন দিল।
দরজা বন্ধ কর দে সুব্রত। মৃদুকণ্ঠে কিরীটী বললে।
দরজাটা খোলাই ছিল, এগিয়ে গিয়ে ভিতর থেকে ছিটকিনি এঁটে দিলাম।
ঘরের সামনে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেই সামনের বড় ট্রামরাস্তাটা এদিক থেকে ওদিক বহুদূর পর্যন্ত চোখে পড়ে।
বারান্দাটা একবার ঘুরে অন্য ঘর দুটোও একবার দেখে নিলাম।
বাকি দুটো ঘর খালি।
ফিরে এলাম আবার কিরীটী যে ঘরে বসে বসে তাস নিয়ে পেসেন্স খেলছিল সেই ঘরে।
.
১৫.
আরও কিছুক্ষণ পরে ঐ রাত্রেই।
কিরীটী কিন্তু তখনও দেখি বসে বসে একমনে পেসেন্স খেলছে। হাতঘড়ির দিকে চেয়ে দেখি রাত সাড়ে এগারোটা বাজে।
কি রে, তোর ব্যাপার কি বল তো? জিজ্ঞাসা করি কিরীটীকে।
কেন? মাথা না তুলেই জবাব দেয় কিরীটী।
না, তাই জিজ্ঞাসা করছি। এখানে এলি কি পেসেন্স খেলবার জন্যে।
তাস সাজাতে সাজাতে কিরীটী বললে, একেবারে মিথ্যে বলি কি করে, কতকটা তাই বটে।
মানে?
বেশ নিরিবিলি, বসে বসে রাত কাবার করে দিলেও কারও আপত্তির কিছু থাকবে না। তুই যদি দেখতিস-ইদানীং কৃষ্ণা কি রকম খিটখিট করে তাস হাতে দেখলেই! সে যাক গে, তোর আপত্তি থাকলে—ঘণ্টাখানেক তুই ঘুমিয়ে নিতে পারিস!
ঘুমিয়ে নেব–মানে?
ঘুমোবি! ঘুমের ঘুম ছাড়া অন্য কোন মানে আছে নাকি?
হ্যাঁ, শুয়ে পড়।
আর তুই বুঝি বসে বসে পেসেন্স খেলবি?
কি করি ব! পেসেন্স খেললে তবু জেগে থাকতে পারব।
বুঝলাম কিরীটী আপাতত জেগে থাকতেই চায়—তা সে যে কারণেই হোক না কেন।
আমি আর কোন কথা না বলে রাস্তার ধারের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম।
রাত্রি গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বড় রাস্তাও নির্জন হয়ে আসছে।
রাস্তায় পথিকের চলাচল কমে এসেছে।
গ্রীষ্মের রাত, নচেৎ এতক্ষণে রাস্তা হয়ত একেবারে নির্জন হয়ে যেত।
হঠাৎ ঐ সময় নজরে পড়ল, রাস্তার ওদিকে পান্থ পিয়াবাস রেস্টুরেন্টটা তখনও খোলা আছে।
ভিতরে এখনও আলো জ্বলছে এবং দরজা এখনও খোলা।
এত রাত্রেও পাপিয়াবাসের অর্গল খোলা! এখনও কি খরিদ্দারের আশা করে নাকি!
পানের দোকানটা এই ফুটপাতে হওয়ায় বোঝা যায় না ওখান থেকে যে, ওটা খোলা। কি বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
মধ্যে মধ্যে ট্যাকশি ও প্রাইভেট গাড়িগুলো রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করছে, তবে সংখ্যাটা অনেক কম।
রিকশারও টুং-টুং শব্দ শোনা যায়।
রাস্তার দুধারের সমস্ত দোকানই বন্ধ।
গ্রীষ্মের রাত-রাস্তায় খাটিয়া পেতে সব শোবার ব্যবস্থা করছে।
ঝিরঝির করে বেশ একটা ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছিল।
তাছাড়া দিনের বেলায় ও রাত দশটা-এগারোটা পর্যন্ত মানুষের চলাচলে, যানবাহনের ভিড়ে, নানাবিধ শব্দে গমগম-করা সেই রাস্তা যখন নির্জন হয়ে যায় তার দিকে তাকিয়ে থাকতে কেমন যেন একটা নেশা ধরে।
তাই বোধ হয় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম।
একসময় খেয়াল হতে তাড়াতাড়ি ঘরে এসে ঢুকলাম, কিন্তু ঘরে ঢুকে দেখি ঘরের মধ্যে আলো জ্বলছে।
টেবিলটার তাস সাজানো রয়েছে কিন্তু কিরীটী ঘরে নেই।
কোথায় গেল কিরীটী?
পাশের ঘরের মধ্যবর্তী দরজাটা খোলাই ছিল। সেদিকে তাকিয়ে দেখলাম ঘরটা অন্ধকার।
সদর দরজার দিকে তাকালাম, সেটা কিন্তু বন্ধ।
বাথরুমেই হয়ত গিয়েছে—মনে করে শয্যায় এসে বসলাম।
কিন্তু পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট করে আধ ঘণ্টা কেটে গেল, কিরীটীর দেখা নেই।
এতক্ষণ কারও বাথরুমে লাগে নাকি!
শয্যা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছি এমন সময় পাশের অন্ধকার ঘরটা থেকে কিরীটী বের হয়ে এল।
কোথায় ছিলি রে?
ছাদে গিয়েছিলাম।
ছাদে।
হ্যাঁ, দেখছিলাম বাথরুমে যাতায়াত করবার জন্য সুইপারদের যে ঘোরানো লোহার সিঁড়িটা আছে সেই সিঁড়িটা দিয়ে সোজা ছাতে চলে যাওয়া যায়। রাত নটার সময় এসে ঘুরে ফিরে দেখতে দেখতেই অবশ্য সব জানা হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু এত রাত্রে ছাতে গিয়েছিলি হঠাৎ?
উর্বশীর খোঁজে।
উর্বশী?
হ্যাঁ রে—সেদিনকার সেই সিগারেট উর্বশীর খোঁজে!