কৃষ্ণার সঙ্গে সেই আলোচনাই হচ্ছিল।
হঠাৎ তার বর্ধমানে কি দরকার পড়ল? শুধালাম আমি।
তা তো কিছু বলে যায়নি। কৃষ্ণা জবাব দেয়।
নির্মলশিববাবুর ব্যাপারেই গেল নাকি?
কে জানে!
ঐ দিনই বেলা তিনটে নাগাদ কিরীটী ফিরে এল।
শুধালাম, হঠাৎ বর্ধমান গিয়েছিলি যে?
এই ঘুরে এলাম। একটা সোফার উপরে বসতে বসতে কিরীটী জবাব দেয়।
তাই তো জিজ্ঞাসা করছি, হঠাৎ সেখানে কি কাজ পড়ল?
কাজ তেমন কিছু নয়, শ্বশুরবাড়ির দেশটা দেখে এলাম।
কার–-কার শ্বশুরবাড়ির দেশ?
তিলোত্তমার। কিন্তু সখি—এবারে কিরীটী কৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে বললে, রন্ধনশালায় কিছু কি অবশিষ্ট আছে?
আছে।
তাহলে স্নানটা সেরে নিই।
কিরীটী উঠে বাথরুমে গিয়ে ঢুকল।
কিরীটী মুখ খুলল আহারাদির পর। আমি, কৃষ্ণা ও কিরীটী তিনজনে তখন ঠাণ্ডাঘরে এসে বসেছি।
গভীর জলের মাছ-এইটুকু বোঝা গেল আজ। হঠাৎ কিরীটী একসময় বললে।
কিরীটীর খাপছাড়া কথায় ওর মুখের দিকে তাকালাম।
কিরীটী ওষ্টধৃত পাইপটায় একটা টান দিয়ে, পাইপটা হাতে নিয়ে এবার বললে, বেচারী নির্মলশিব তাই কোন হদিস করতে পারেনি!
তুই আহলে হদিস করতে পেরেছিস, বল? প্রশ্ন করলাম আমি।
পুরোপুরি হদিস করতে পারিনি বটে তবে মোটামুটি রাস্তাটা—মনে হচ্ছে বোধ হয় খুঁজে পেয়েছি।
রাস্তা।
হ্যাঁ, চারটে ঘাঁটির সন্ধান পেয়েছি কিন্তু শেষ অর্থাৎ পঞ্চম ঘাঁটিটা কোথায় সেটা জানতে পারলেই কিভাবে কোথা দিয়ে চোরাই সোনার লেন-দেনটা হয় জানতে পারতাম।
চারটে ঘাঁটির সন্ধান পেয়েছ! কৃষ্ণা প্রশ্ন করে এবার।
হ্যাঁ, এক নম্বর ঘাঁটি হচ্ছে ওভারসিজ লিঙ্ক, দু নম্বর চায়না টাউন, আর তৃতীয় ঘাঁটি পানের দোকানটি এবং অনুমান যদি আমার ভুল না হয় তো চতুর্থ ঘাঁটি হচ্ছে পান্থ পিয়াবাস। অবিশ্যি স্বীকার করতেই হবে, খুব planned way-তে কারবারটা চলছে যাতে করে কোনক্রমে কোন দিক থেকে তাদের উপরে সন্দেহ না জাগে কারও বিন্দুমাত্রও।
কিরীটীর কথার মধ্যে ঐ সময় ঘরের কোণে রক্ষিত ফোনটা ক্রিং ক্রিং করে বেজে উঠল।
কিরীটীই তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে ফোনটা ধরল, হ্যালো! কে, বাজোরিয়া? হ্যাঁ,–রায় কথা বলছি। পাওয়া গিয়েছে। Good-সুসংবাদ। আজ থেকেই তাহলে ফ্ল্যাটটা পাওয়া যাবে বলছ! তবে আজই যাব! হা হা-আজই। সব ব্যবস্থা করে ফেল। ঠিক আছে।
কিরীটী ফোনটা নামিয়ে রেখে এসে পুনরায় সোফায় বসল।
কি ব্যাপার, কে ফোন করেছিল? কি ফ্ল্যাটের কথা বলছিলে ফোনে? কৃষ্ণা শুধায়।
ওভারসিজ লিঙ্কের উপরে একটা খালি ফ্ল্যাট পাওয়া গিয়েছে। কিরীটী মৃদুকণ্ঠে বলে।
ওভারসিজ লিঙ্কের উপর খালি ফ্ল্যাট!
হ্যাঁ।
তা হঠাৎ ফ্ল্যাটের তোমার কি প্রয়োজন হল?
এক বাড়িতে বেশি দিন থাকা স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল নয়। তাই একটু বাসা বদল আর কি।
মানে সেখানে তুমি যাচ্ছ?
হ্যাঁ, একটা সুটকেসে কিছু জমা-কাপড় আর বেডিং তৈরি করে রাখ।
কি হেঁয়ালি শুরু করলে বল তো! বলে কৃষ্ণা।
বাঃ, ঐ দেখ! হেঁয়ালি এর মধ্যে কি দেখলে? দিনকতক গিয়ে এই ফ্ল্যাটটায় থাকব একটু নিরিবিলিতে ভাবছি।
ফ্ল্যাটটায় থাকবে!
হ্যাঁ, অবিশ্যি একা নয়,–সহ সুব্রত।
আমি? প্রশ্নটা করে আমি কিরীটীর মুখের দিকে তাকালাম।
কি আশ্চর্য, নিশ্চয়ই তুই! কি আশ্চর্য! নির্মলশিবকেও অবশ্যি নেওয়া যেত কিন্তু ভিখারী সাহেবের চক্ষুকে কি ফাঁকি দিতে পারবে নির্মলশিববের ঐ বিশেষ প্যাটার্নের চেহারাটা?
কোন আর প্রতিবাদ করলাম না। কারণ বুঝতে পেরেছি তখন, সবটাই কিরীটীর পূর্বপরিকল্পিত।
এবং এও বুঝতে পেরেছি, ওর সঙ্গে গিয়ে আমাকে সেই ফ্ল্যাটে আপাতত কিছু দিন থাকতে হবে। কেন যে তার মাথায় হঠাৎ ঐ পরিকল্পনার উদ্ভব হয়েছে তারও কোন উত্তর যে আপাতত ওর কাছ থেকে পাওয়া যাবে না তাও জানি।
তাই বললাম, তাহলে আমি উঠি!
উঠবি? ব্যস্ত কেন, বোস্।
বাঃ, তোর সঙ্গে যেতে হবে বললি!
হ্যাঁ, সে তো রাত এগারোটায়। এখন বোস, সন্ধ্যানাগাদ বের হয়ে যাবি, তারপর রাত ঠিক এগারোটায় গিয়ে হাজির হবি ৫নং ফ্ল্যাটে।
কিন্তু–
আমি থাকব। অতএব কিন্তুর কোন প্রয়োজন নেই।
তুই কখন যাবি?
যথাসময়ে।
.
বলাই বাহুল্য ওভারসিজ লিঙ্কের ফ্ল্যাটে গিয়ে না উঠলে এই ব্যাপারের গুরুত্বটা সত্যিই বোধ হয় অত শীঘ্র উপলব্ধি করতে পারতাম না।
আর সেখানে না গেলে অত তাড়াতাড়ি সীতা মৈত্রর পরিচয়টাও পেতাম না।
অথচ সীতা মৈত্রের পরিচয়টা জানা যে আমাদের কতখানি প্রয়োজন ছিল সেটা পরে বুঝতে পেরেছিলাম।
আর এও বুঝেছিলাম, সেবারে কিরীটীর সূক্ষ্ম দৃষ্টি কতদূর পর্যন্ত দেখতে পায়।
যাক যা বলছিলাম—
রাত এগারোটা বেজে ঠিক সাত মিনিটে গিয়ে ৫নং ফ্ল্যাটে পৌঁছাতেই দরজা খুলে গেল।
কিরীটী পূর্ব হতেই তার কথামত ফ্ল্যাটে উপস্থিত ছিল। সে আহ্বান জানাল, আয়।
ভিতরে প্রবেশ করে সিঁড়ি বেয়ে উঠবার সময় যথাসম্ভব বাড়িটার গঠনকৌশল ও প্ল্যান দেখে নিয়েছিলাম।
প্রায় সাত কাঠা জায়গার উপরে বাড়িটা।
ভিতরে একটা চতুষ্কোণ বাঁধানো আঙিনা।
সেই আঙিনার দক্ষিণদিকে সোজা খাড়া প্রাচীর দোতলা পর্যন্ত উঠে গেছে।
সেই প্রাচীরের ওপাশে অনেকটা জায়গা জুড়ে একটা টিনের শেড দেওয়া মোটর রিপেয়ারিংয়ের কারখানা।
তারপরেই তিনতলা দুটো বাড়ি পাশাপাশি।
ঐ দুটো বাড়ির মধ্য দিয়ে অপ্রশস্ত কাঁচারাস্তা কারখানায় প্রবেশের। সেই বাড়ি দুটো রাস্তার উপর।