ছোট ঐ একচিলতে জায়গার মধ্যেই কাঠ ও চট সহযোগে একটা পার্টিশন দিয়ে চা ও অন্যান্য সব কিছু তৈরির ব্যবস্থা।
অর্থাৎ রেস্টুরেন্টের রন্ধনশালা বা প্যান।
আর বাকি অংশে মালিকের ছোট টেবিল ও টুলটি ছাড়া ছটি টেবিল ও প্রত্যেক টেবিলের সঙ্গে চারটি করে চেয়ার পাতা।
হোটেলের মালিকের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছিই হবে বলেই যেন মনে হল।
রীতিমত কৃষ্ণবর্ণ ও গোলালো মাংসল চেহারা লোকটার। গায়ে বোধ হয় একটা মার্কিনের পাঞ্জাবি।
ঘরে ঘূর্ণমান ইলেকট্রিক পাখা থাকা সত্ত্বেও হাতে একটি তালপাতার পাখা সবেগে চালনা করছিল লোকটা থেকে থেকে, কারণ লোকটা ঘেমে একেবারে স্নান করে যাচ্ছিল।
আমাদের রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করতে দেখেই সবেধন নীলমণি ছোকরা চাকরটি এগিয়ে আসে।
কি দেব বাবু?
দু কাপ চা দে। কিরীটী বললে।
রাস্তার দিকে মুখ করে দরজা ঘেঁষে একেবারে দুজনে বসলাম দুটো চেয়ার টেনে।
কিরীটীর দিকে চেয়ে দেখি সে যেন অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে বাইরের দিকে।
এবং চেয়ে আছে—যেন মনে হল, রাস্তার অপর ফুটপাতের ধারে সামনের দোকানটার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সেই উর্বশী সিগারেটের ভ্যানটার দিকেই।
আর ঐ সঙ্গে নজরে পড়ল, খাকী বুশ-কোট ও প্যান্ট পরিহিত—বোধ করি ঐ ভ্যানেরই ড্রাইভারটা, পাশের দোকানটার সমানে দাঁড়িয়ে দোকানদারের সঙ্গে কথা বলছে।
ছোকরা চাকরটা এসে দুকাপ চা আমাদের দুজনের সামনে টেবিলটার উপরে নামিয়ে দিয়ে গেল।
কিরীটীর কিন্তু যেন সেদিকে ভ্রূক্ষেপও নেই।
থেকে থেকে ওষ্ঠধৃত সিগারটায় টান দিতে দিতে একাগ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। বাইরের দিকে দেখলাম তখনও।
বললাম, কি দেখছিস?
উর্বশী সিগারেট খেয়েছিস কখনও সুব্রত? পালটা প্রশ্ন করে আমার প্রশ্নের জবাবে কিরীটী।
না। বললাম।
খেয়ে দেখ—এই নে, বলে পকেট থেকে সত্যি সত্যিই একটা সিগারেটের প্যাকেট বের করে দিল।
আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, সেদিন যে ঐ দোকান থেকে দু-তিন প্যাকেট সিগারেট ও কিনেছিল তারই একটা।
কি বলব ভাবছি
এমন সময় কিরীটী আবার বললে, তা যা-ই বলিস, সিগারেটের ব্যবসা কিন্তু লাভজনক।
বললাম, জানি।
লেকের ধারে একটা বিরাট নতুন বাড়ি হয়েছে দেখেছিলাম—
নজর করিনি, কোন বাড়িটার কথা বলছিস?
বিরাট চারতলা গেট ও লনওয়ালা বাড়িটার কথা বলছি। বাড়িটা শুনেছি এক বিড়ির ব্যবসায়ীর-হনুমানজী বিড়ি। কিন্তু–
কি?
মোহিনী বিড়ি, মহালক্ষ্মী বিড়ি, হনুমানজী বিড়ি, হাউইজাহাজ বিড়ি, রেলমার্কা বিড়ি নানা-ধরনের জিজ্ঞাপন দেখেছি, কিন্তু সিগারেট বলতে তো সবেধন নীলমণি ন্যাশন্যাল টোবাকো কোম্পানি। হঠাৎ উর্বশী সিগারেট যে কোথা থেকে এলেন বুঝতে তো পারছি না! তাছাড়া এর আগে ঐ নামটা চোখে পড়েছে বলেও তো মনে পড়ছে না।
তুই তো আর সিগারেট খাস না, খেলে হয়ত নজরে পড়ত।
তা বটে! অনেকগুলো প্যাকেট ভ্যান থেকে নামাচ্ছে দেখছি!
হুঁ। ব্যবসাটা বেশ জমে উঠেছে মনে হচ্ছে। তাই ভাবছি উর্বশীর আবির্ভাব কবে থেকে হল এ শহরে?
আমি ব্যাপারটায় আদৌ মনোযোগ দিইনি গোড়া থেকেই। তাই একটু হালকাভাবেই কথাগুলো বলছিলাম।
কিন্তু কিরীটীর পরবর্তী কথায় হঠাৎ যেন এতক্ষণে মনে হল আমার, কিরীটীর আজকের দ্বিপ্রহরের অভিযানটা ঐ পানের দোকানটিকে কেন্দ্র করেই।
এবং এতক্ষণে বুঝতে পারলাম, এই খর রৌদ্রতাপেও কিরীটীকে ঐ পানের দোকানটিই ঘরের বাইরে টেনে এনেছে।
কিন্তু নিশ্চয়ই তোর সীতা মৈত্র—আমাদের সেক্রেটারি দিদিমণি সিগারেট খায় না সুব্রত!
বলাই বাহুল্য, কিরীটীর ঐ কথার সঙ্গে সঙ্গেই আমার দৃষ্টি পানের দোকানটার প্রতি আকৃষ্ট হয়।
দেখলাম, আশ্চর্য, সত্যিই সীতা মৈত্রই তো!!
কাঁধে একটা র্যাশন ব্যাগের মত ব্যাগ ঝুলিয়ে পানের দোকানটার দিকে চলেছে ছাতা মাথায় দিয়ে।
সেই দিকেই তাকিয়ে রইলাম।
সীতা মৈত্র সোজা উর্বশী সিগারেট ভ্যানটার মধ্যে উঠে বসল এবং সঙ্গে সঙ্গেই ভ্যানটা ছেড়ে দিল।
ব্যাপারটা যেমনি বিস্ময়কর তেমনি আকস্মিক।
অতঃপর কিংকর্তব্য! মনে মনে বোধ হয় নিজের অজ্ঞাতেই তাই ভাবছিলাম।
হঠাৎ ঐ সময় আবার কিরীটীর কথায় চমকে উঠলাম, তোর নাম কি রে?
চেয়ে দেখি কিরীটীর সামনে দাঁড়িয়ে তখন রেস্টুরেন্টের সবেধন নীলমণি ছোকরাটি।
এজ্ঞে গদাই।
গদাই কি?
এজ্ঞে ঢোল।
কত মাইনে পাস এখানে?
এজ্ঞে কিছুই না।
হঠাৎ সেইসময় হোটেলের মালিকের গর্জন শোনা গেল, এই গদাই, এদিকে আয়!
গদাই তাড়াতাড়ি মনিবের ডাকে এগিয়ে গেল।
ওঠ সুব্রত। কিরীটী মৃদু হেসে বললে।
কোথায় যাবি?
কোথায় আবার যাব–বাড়ি যেতে হবে না?
রেস্টুরেন্টের দাম মিটিয়ে দিয়ে দুজনে রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম।
কয়েক পা অগ্রসর হতেই একটা খালি ট্যাকশি পাওয়া গেল।
হাত-ইশারায় ট্যাকশিটা থামিয়ে কিরীটী আমাকে নিয়ে ট্যাকশিতে উঠে বসল।
পথে কিরীটী একেবারে চুপ করে বসে রইল চলন্ত ট্যাকশির মধ্যে।
বুঝলাম গভীরভাবে কিছু একটা ও চিন্তা করছে।
এসময় কোন প্রশ্ন করলেও জবাব মিলবে না।
.
১৪.
দিন দুই পরে একদিন দ্বিপ্রহরে।
কিরীটীর বাড়িতেই তার ঠাণ্ডাঘরে বসে কৃষ্ণার সঙ্গে গল্প করছিলাম।
গত পরশু সকালে কিরীটী কৃষ্ণাকে বলে গিয়েছে বর্ধমানে সে যাচ্ছে একদিনের জন্য। কিন্তু দুইদিন হতে চলল প্রায় তার এখনও দেখা নেই।