কি আশ্চর্য! তাহলে আমি কি করব বলতে পারেন?
আজ নয়, তিনদিন বাদে আসুন এই সময়, বলব।
কি আশ্চর্য! কিন্তু
কিন্তু নয়। জানেন না, সবুরে মেওয়া ফলে। শনৈঃ শনৈঃ পর্বত লম্বন করতে হয়—শাস্ত্রের বচন।
অতঃপর কতকটা ক্ষুন্ন মনেই বেচারী নির্মলশিবকে সেদিনের মত বিদায় নিতে হল।
.
আরও আধ ঘণ্টা পরে।
সহসা কিরীটী গাত্রোখান করে বলল, চল্ সুব্রত, বাইরে থেকে একটু ঘুরে আসা যাক।
বেলা তখন প্রায় বারোটা।
গ্রীষ্মের প্রখর রৌদ্রের তাপে বাইরেটা তখন যে ঝলসে যাচ্ছে অনায়াসেই সেটা বোঝা যায় ঘরের মধ্যে বসেও।
বললাম, এই অসময়ে?
বেরুবার আবার সময় অসময় আছে নাকি? চল–ওঠ!
অগত্যা উঠতেই হল।
এবং ঐ প্রখর রৌদ্রতাপের মধ্যে বাইরে বের হয়ে পদব্রজেই কিরীটী নির্বিকারচিত্তে পথ অতিক্রম করে চলল এবং বলাই বাহুল্য আমাকেও তার সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে চলতে হল।
হাঁটতে হাঁটতে লক্ষ্য করলাম কিরীটী ওভারসিজ লিঙ্কের অফিসের দিকেই চলেছে।
তবু জিজ্ঞাসা করলাম, কোথায় চলেছিস?
পান খাব। কিরীটী মৃদুকণ্ঠে হাঁটতে হাঁটতে বলে।
কিন্তু চলেছিস কোথায়?
বললাম তো পান খেতে।
পান?
হ্যাঁ, লোকটা–-মনে নেই পানওয়ালাটা চমৎকার পান সাজে রে, সেদিন চমৎকার লেগেছিল! বলতে বলতে হঠাৎ কিরীটী দাঁড়িয়ে যায়।
দাঁড়ালি কেন?
না, কিছু না চল—চলতে শুরু করে আবার।
কয়েক পা চলে আবার কিন্তু দাঁড়ায়।
এবার মিনিট দুই-তিন দাঁড়িয়ে থেকে আবার চলতে শুরু করে।
ব্যাপারটা কিন্তু এবার কিছুটা অনুমান করেই পিছনে তাকালাম।
হাত দশ-পনেরো দুরে দেখি, একটি জীর্ণ বেশ পরিহিত পথের ভিক্ষুক লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
মৃদুকণ্ঠে এবারে কিরীটী বলল, ঐ ভিখিরীটা বোধহয় ভিক্ষে চায় না সুব্রত।
পুনরায় হাঁটতে শুরু করে এবং হাঁটতে হাঁটতেই কথাটা বলে কিরীটী।
তাই মনে হচ্ছে নাকি?
হুঁ, সেই দোরগোড়া থেকেই একেবারে দেখছি অনুগত দেবর লক্ষ্মণের মতই আমাদের অনুগমন করে আসছে।
কথাটা কিরীটী বললে বটে, তবে মনে হল কিরীটী অতঃপর যেন আর পিছনের ভিখারীটার দিকে কোন মনোযাগই দিল না।
হাঁটতে লাগল।
ততক্ষণ আমরা পানের দোকানের কাছাকাছি এসে গিয়েছি।
কিন্তু আজ দেখলাম, পানের দোকানে অন্য একটি লোক বসে।
কিরীটী ক্ষণকাল লোকটার দিকে তাকিয়ে বলে, চার আনার ভাল পান সেজে দাও তো।
মিঠা না সাদা পান বাবু?
মিঠা নয়, সাদা। জর্দা কিমাম দিয়ে দাও।
লোকটি পান সাজতে লাগল।
আড়চোখে লক্ষ্য করে দেখলাম সেই ভিখারীটা অল্পদূরে একটা লাইটপোস্টে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে হাত পেতে পথচারীদের কাছে ভিক্ষা চাইছে।
.
১৩.
কিরীটী অদূরবর্তী সেই ভিখারীর কথা উল্লেখ করার পর থেকেই আমার নজরটা সেই ভিখারীর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল।
কিরীটী যখন পানওয়ালার সঙ্গে কথা বলছে, আমার নজর তখন ভিখারীর প্রতিই নিবদ্ধ।
একটু অন্যমনস্ক হয়েছিলাম।
হঠাৎ সেই সময় কিরীটীর চাপা কণ্ঠস্বরে চমকে উঠি।
সুব্রত!
কি?
ঐ ভিখারী সাহেবকে চিনতে পারছিস?
অ্যাঁ! কি বললি?
বলছি ঐ ভিখারী সাহেবটিকে চিনতে পারছিস?
সত্যি কথা বলতে কি, তখনই লোকটা ভিখারীর ছদ্মবেশে যে আসলে কে বুঝে উঠতে পরিনি বলেই সেই দিকেই তখনও তাকিয়ে ছিলাম।
এবার কিরীটীর কথায় অদূরে দণ্ডায়মান ভিখারীর দিকে ভাল করে তাকালাম আর একবার।
চেহারা দেখে লোকটার বয়স ঠিক ঠিক বোঝবার উপায় নেই।
তবে মোটামুটি মধ্যবয়সী বলেই লোকটিকে মনে হয় ছদ্মবেশ থাকা সত্ত্বেও। পরিধানে একটা জীর্ণ সেলাই-করা মলিন ঝলমলে গরম প্যান্ট।
গায়ে অনুরূপ একটা টুইডের ওপন-ব্রেস কোট।
মাথায় একটা বহু পুরাতন জীর্ণ ফেল্ট ক্যাপ!
মুখভর্তি খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। হাতে একটা মোটা লাঠি।
ভিক্ষার জন্য পথচারীদের কাছে হাত পেতে দাঁড়িয়ে থাকলেও সেটা যে একটা ভেক মাত্র সেটা এবারে লোকটার দিকে কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবার পরই বুঝতে পারলাম।
এবং ভিক্ষাটা যখন একটা ভেক মাত্র, লোকটার পোশাক ও বাইরের চেহারাটার মধ্যেও যে ছল রয়েছে, সেটাও তো সহজেই অনুমেয়।
কিন্তু তবু যেন চিনতে পারলাম না লোকটাকে।
এমন সময় কিরীটীর মৃদু আকর্ষণে ওর মুখের দিকে তাকাতেই নিম্নকণ্ঠে সে বললে, চ-গলাটা বড় শুকিয়ে গিয়েছে, সামনে ঐ পান্থ পিয়াবাস থেকে চা দিয়ে গলাটা ভিজিয়ে নেওয়া যাক।
আমি এবারে কিরীটীর প্রস্তাবে দ্বিরুক্তি মাত্রও না করে রাস্তা অতিক্রম করে অপর দিককার ফুটপাতের সামনের দোকানটার মুখোমুখি প্রায় চায়ের রেস্টুরেন্টের দিকে এগিয়ে চললাম।
এবং ঠিক যেন ঐ সময়েই একটা চকচকে ভ্যান আমাদের পাশ কাটিয়ে গিয়ে পাশের দোকানটার সামনে রাস্তার উপরে ব্রেক কষে দাঁড়াল।
ভ্যানটার গায়ে একটি নর্তকীর ছবি আঁকা ও তার মাথায় লেখা উর্বশী সিগারেট!
ভ্যানটা প্রায় আর একটু হলেই আমাদের চাপা দিয়ে যাচ্ছিল—এমন ভাবে গা ঘেঁষে গিয়েছিল।
যাই হোক, দুজনে এসে অপর ফুটপাতে পান্থ পিয়াবাস রেস্টুরেন্টের মধ্যে প্রবেশ করলাম।
ছোট রেস্টুরেন্ট, ঐ সময়টা প্রায় নির্জনই ছিল।
মাত্র একটি চা-পিয়াসী লোক বসে বসে চা পান করছিল।
ঘর বলা যায় না—একটা চিলতে-মত জায়গায় রেস্টুরেন্টটি।
সিলিং থেকে দুটি ঘূর্ণমান পাখা এবং দুটি পাখাই যে কতকালের পুরানো তার ঠিক নেই। ঘড়ং ঘড়ং একটানা শব্দ তুলে যেভাবে ঘুরছে তার তুলনায় হাওয়া কিছুই দিচ্ছে না।