ঠিক এমনি সময় একদিন বেলা এগারোটা নাগাদ রীতিমত যেন হন্তদন্ত হয়ে নির্মলশিব এসে ঘরে প্রবেশ করল কিরীটীর।
কি আশ্চর্য! মিঃ রায়–
কিরীটী পূর্বের মতই তাস নিয়ে খেলছিল, সঙ্গে সঙ্গে মুখ তুলে হাতের তাসগুলো একান্ত অবহেলায় টেবিলের উপরে একপাশে ঠেলে দিয়ে, যেন আপাতত তার প্রয়োজন। ফুরিয়েছে, নিশ্চিন্ত দৃষ্টিতে নির্মলশিবের মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, কি, ইতিহাসের আবার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে-এই তো নির্মলশিব বাবু?
কি আশ্চর্য! ইতিহাস—
হ্যাঁ,–নির্বিকার ভাবেই পুনরাবৃত্তি করে কথাটা কিরীটী।
কি আশ্চর্য! সুব্রতবাবু, এক গ্লাস জল!
আমি দরজার কাছে উঠে গিয়ে জংলীকে এক গ্লাস জল দিতে বললাম।
জংলী জল আনার পর চো চো করে এক গ্লাস জল প্রায় এক টানেই নিঃশেষ করে নির্মলশিব বলে, আর এক গ্লাস।
জংলী শূন্য গ্লাসটা নিয়ে চলে গেল।
কিন্তু ততক্ষণে এক গ্লাস জল পান করে কিছুটা ধাতস্থ হয়েছে নির্মলশিব।
সে বললে, আবার খুন হয়েছে আমার এলাকায় মিঃ রায়!
জানতাম হবে। নির্বিকার ভাবেই কিরীটী কথাটা বলে।
জানতেন?
হ্যাঁ, এবং আপনার কাছে সংবাদটা পেয়ে দুটো ব্যাপার অন্তত প্রমাণিত হল।
দুটো ব্যাপার?
হ্যাঁ।
মানে?
প্রথমত আপনার ঐ এলাকার সঙ্গেই যে স্বর্ণমৃগয়ার একটা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে আমার সেই অনুমানটা, এবং দ্বিতীয়ত খুব শীঘ্রই পূর্বের সেই হত্যাকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি ঘটবে সেটা। বিশেষ করে যে সংবাদটার জন্য এই কয়দিন সত্যিই আমি অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু যাক সেকথা। নিহত ব্যক্তিটি কে—তার কোন পরিচয় পেলেন বা তাকে আইডেনটিফাই করতে পারা গিয়েছে?
না, তবে—
তবে কি?
লোকটার বাঁ হাতে হিন্দীতে উল্কি করে করে নাম লেখা আছে—
কি নাম লেখা আছে?
ভিখন—
কি, কি বললেন? কি নামটা বললেন? উত্তেজিত কণ্ঠে কিরীটী প্রশ্নটার পুনরাবৃত্তি করল।
ভিখন।
ভিখন?
হ্যাঁ।
লোকটার গায়ের রঙ কালো? আবার প্রশ্ন করল কিরীটী।
হ্যাঁ।
কপালে ডানদিকে একটা কাটা দাগ আছে?
আছে-কি আশ্চর্য!
নাকের উপর একটা আঁচুলি আছে?
আছে। কিন্তু কি আশ্চর্য। এসব কথা, মৃতদেহ সম্পর্কে এত ডিটেলস্ আপনি জানলেন কি করে? আপনি কি মর্গে গিয়ে ইতিমধ্যে মৃতদেহটা দেখে এসেছেন নাকি মিঃ রায়?
না, আপনিই তো দেখেছেন!
কি আশ্চর্য! তা তত দেখেছিই, কিন্তু আপনি এত সব জানলেন কি করে?
বাঃ, আপনিই তো বললেন সব! যাক সেকথা, কি ভাবে লোকটাকে হত্যা করা হয়েছে?
শ্বাসরুদ্ধ করেই অর্থাৎ স্ট্রাগল করেই অবিশ্যি তাকে হত্যা করা হয়েছে, তবে কি বলব মিঃ রায়, কি আশ্চর্য, কোন রকম ভাবে কোন স্লাঙ্গল করার কোন চিহ্নই গলায় নেই মৃতের।
পোস্টমর্টেমে বুঝি প্রমাণিত হয়েছে?
কি আশ্চর্য! পোস্টমর্টেম এখনও তো হয়ইনি। পুলিশ সার্জেনের তাই মত।
অভিমত! ও, তা মৃতদেহটা আবিষ্কৃত হল ঠিক কোথায়?
কালীঘাট ব্রিজের তলায়।
হত্যাকারীর তাহলে বলুন এখনও কিছুটা ধর্মভীতি রয়েছে।
কি আশ্চর্য। তার মানে?
এটা বুঝলেন না—সম্মুখেই পতিতোদ্ধারিণী মা গঙ্গা, আর হাত বাড়ালেই সর্বপাপহারিণী সর্বমঙ্গলা মা কালী। হত্যার পাপ যদি হয়েই থাকে, তাতেই স্থলন হয়ে গিয়েছে।
কথাগুলো বলে কিরীটী মৃদু হাসতে লাগল।
.
১২.
আমি কিন্তু তখনও রীতিমত অন্ধকারে হাতড়াচ্ছি।
মৃতের অনুরূপ কোন ব্যক্তিবিশেষকে স্মৃতির সাহায্যে মনের মধ্যে তোলপাড় করে খুঁজছি।
কিরীটী এমন সময় আবার কথা বললে, আপনার অনুসন্ধানের কাজটা তো এবার অনেক সহজ হয়ে এল নির্মলশিববাবু!
কি আশ্চর্য! সত্যি বলছি, দয়া করে আপনার হেঁয়ালি ছেড়ে সহজ করে যা বলবার বলুন।
সহজ করেই বলছি। কিন্তু তার আগে আপনার উপরে যে কাজের ভার দিয়েছিলাম, তার কি করলেন বলুন তো?
কোন কাজ?
বিশেষ কোন নম্বরের ট্যাকশির বা ভ্যানের ওভারসিজ লিঙ্কে যাতায়াত আছে কিনা সংবাদটা পেলেন কিছু?
না। গত কদিন ভিন্ন ভিন্ন নম্বরের অন্তত গোটা পঁচিশেক ট্যাকশি ও ভ্যান ঐ অফিসে যাতায়াত করতে দেখা গিয়েছে।
হুঁ। সোনার কারবারীরা খুবই সতর্ক আছে দেখছি। তবে টোপ যখন গিলেছে একবার, ফসকে যেতে নিশ্চয়ই পারবে না।
কি আশ্চর্য! টোপ গিলেছে!
হ্যাঁ। ভিখনের মৃত্যুটা সেই টোপ গেলবারই আকাট্য নিদর্শন।
নির্মলশিব তারপর আরও কিছুক্ষণ ধরে নানা ভাবে নানা প্রশ্ন করে কিরীটীর কাছ থেকে ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার করে জানবার—যাকে বলে আপ্রাণ চেষ্টা করল, কিন্তু কিরীটী সেদিক দিয়েই গেল না আর।
নির্মলশিব যেন একটা বিষণ্ণই হয়ে পড়ে।
কিছুক্ষণ মুখ গোমড়া করে বসে থাকে।
অবশেষে একসময় বলে, আমি কিন্তু একজনকে অ্যারেস্ট করব বলে একপ্রকার স্থিরই করে ফেলেছি ইতিমধ্যে মিঃ রায়।
অ্যারেস্ট করবেন? কাকে? এতক্ষণে মুখ তুলে তাকাল কিরীটী, একটু যেন কৌতুকের সঙ্গেই।
আর্থার হ্যামিলটনকে। নির্মলশিব বললে।
সে কি! কেন?
আমার স্থির বিশ্বাস ওকে অ্যারেস্ট করলেই ঐ দলটার অনেক গোপন কথা পাওয়া যাবে।
সত্যিই পাওয়া যাবে মনে করেন?
নির্ধাৎ পাওয়া যাবে।
এ ধারণা আপনার কেন হল বলুন তো?
কেন?
হুঁ।
ও একটি বাস্তুঘুঘু।
বাস্তঘুঘু।
হ্যাঁ। ওকে চাপ দিলেই অনেক কিছু প্রকাশ হয়ে পড়বে। নির্ঘাত ও অনেক কিছু জানে।
কিরীটী প্রত্যুত্তরে এবারে হাসল।
কি আশ্চর্য। হাসছেন যে?
কারণ তাতে করে আপনি, যেটুকু এ কদিন এগিয়েছেন তার দশগুণ আপনাকে পিছিয়ে আসতে হবে।