কেমন বিহ্বল হয়েই যেন ওদের গমনপথের দিকে তাকিয়ে ছিলাম আমি।
হঠাৎ কিরীটীর মৃদু কণ্ঠস্বরে ওর দিকে মুখ ফেরালাম।
বন থেকে বেরুল টিয়ে সোনার টোপর মাথায় দিয়ে! টিয়া পাখি উড়ে গেলসুব্রতচন্দ্র এবারে গৃহে চল!
তারপরই হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললে, উঃ, রাত বারোটা বাজতে মাত্র চোদ্দ মিনিট। গৃহিণী নিরতিশয় ব্যাকুল হয়ে পড়েছে নিশ্চয়ই।
তা হবারই তো কথা, সান্ধ্যভ্রমণ যদি মধ্যরাত্রি পর্যন্ত গড়ায়-মৃদু হেসে বললাম আমি, ব্যাকুলা তো হবেনই।
তাড়াতাড়ি বিল চুকিয়ে দিয়ে আমরা হোটেলের বাইরে চলে এলাম।
হোটেলের বাইরে এসে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলাম।
একটু আগে হ্যামিলটনকে নিয়ে এই পথেই চিরঞ্জীব কাঞ্জিলাল হোটেল থেকে বের হয়ে এসেছে।
কিন্তু কাউকে দেখতে পেলাম না।
কিরীটী আমাকে তাড়া দিয়ে বলল, নেই হে বন্ধু সে টিয়া পাখি অনেক আগেই উড়ে গিয়েছে। এবারে একটু পা চালিয়েই চল, কারণ পাড়াটা বিশেষ করে এই মধ্যরাত্রে তেমন সুবিধার নয়।
ট্রামরাস্তায় এসেও অনেক অপেক্ষার পর ট্যাকশি মিলেছিল সেরাত্রে এবং কিরীটীকে তার গৃহে নামিয়ে দিয়ে বাসায় পৌঁছতে রাত সোয়া একটা বেজে গিয়েছিল।
.
০৯.
সেই রাত্রের পর পুরো দুটো দিন কিরীটী আর বাড়ি থেকে কোথাও এক পাও বেরুল না।
কেবল নিজের বসবার ঘরে বসে বসে দুটো দিন সর্বক্ষণ পেসেন্স খেলা নিয়েই মেতে হইল।
তৃতীয় দিনও দ্বিপ্রহরে গিয়ে দেখি বসবার ঘরে চারিদিকে লাল পর্দা টেনে এয়ারকন্ডিশন মেশিন চালিয়ে ঠাণ্ডায় বসে পেসেন্স খেলছে সে।
আজ কিন্তু সত্যিই আমার ধৈর্যচ্যুতি ঘটবার উপক্রম হয়।
কারণ গত দুটো দিন আমার মনের মধ্যে সর্বক্ষণ সেরাত্রের ঘটনাগুলি ও কতকগুলো নরনারীর মুখ ভেসে ভেসে উঠছিল।
মনে মনে একটা আঁচও করে নিয়েছিলাম যে, অতঃপর নিশ্চয়ই তোড়জোড় করে কিরীটী গিয়ে ওভারসিজ লিঙ্কে হানা দেবে।
কিন্তু কিরীটী যেন সেরাত্রের ব্যাপার সম্পর্কে একেবারে বোবা।
ধৈর্যচ্যুতি ঘটতও হয়ত আর একটু পরেই, কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে সিঁড়িতে জুতোর শব্দ পেয়ে উৎকর্ণ হই।
জুতোর শব্দটা ঠাণ্ডা ঘরের দরজা বরাবর যখন প্রায় এসেছে, কিরীটী তাস সাজাতে সাজাতেই আমাকে বললে, দরজাটা খুলে দে সুব্রত, নির্মলশিব এলেন!
সত্যি দরজা খুলে দিতে নির্মলশিবই এসে ঘরে প্রবেশ করল।
ঘরে পা দিয়েই নির্মলশিব বলে, আঃ, প্রাণটা বাঁচল! কি আশ্চর্য! কি ঠাণ্ডা।
কিরীটী তাস সাজাতে সাজাতেই বলল, মল্লিক সাহেবের সঙ্গে আলাপ হল নির্মলশিববাবু?
কি আশ্চর্য! তা আর করিনি! খাসা লোক—তবে—
তবে আবার কি?
প্রচণ্ড সাহেব।
তা বাঙালীরা ধুতি ছেড়ে কোট পাতলুন পরিধান করলে একটু সাহেব হয়ে পড়েন বৈকি। কিন্তু যেজন্য আপনাকে সেখানে যেতে বলেছিলাম তার কোন সংবাদ পেলেন কিনা?
কি আশ্চর্য! তা পেয়েছি বৈকি।
পেয়েছেন তাহলে!
হ্যাঁ।
বিদেশে কোন মালটা বেশি রপ্তানি হয় ওদের, জানতে পারলেন কিছু?
হ্যাঁ। চা, চাটনি আর ছাতি।
ছাতি?
হ্যাঁ,–আমব্রেলা। আমেরিকায় নাকি প্রচুর চা আর ছাতি চালান যাচ্ছে আর বোয়ামে বোয়ামে ভর্তি হয়ে যাচ্ছে আমের আচার।
আমের আচার আর ছাতার স্যাম্পল দিলে বুঝি আপনাকে?
স্যাম্পল মানে?
না, বলছিলাম, শুধু ছাতি আর আমের আচার-সিঙ্গাপুরী কলা নয়!
বেচারী নির্মলশিব, কিরীটীর সূক্ষ্ম পরিহাস উপলব্ধি করবে কি করে? আমি কিন্তু ততক্ষণে রুদ্ধ হাসির বেগটা আর না সামলাতে পেরে হো-হো করে হেসে উঠলাম।–
কি আশ্চর্য! সুব্রতবাবু, আপনি হাসছেন?
নির্মলশিববাবুর কথায় কিরীটীও এবারে হেসে ওঠে।
.
যাক, সীতা আর আর্থার হ্যামিলটনের খোঁজ নিয়েছিলেন নির্মলশিববাবু? কিরীটী আবার প্রশ্ন করল।
কি আশ্চর্য! নিয়েছিলাম বৈকি। হাজবেন্ড অ্যান্ড ওয়াইফ। তবে বর্তমানে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ওদের সেপারেশন হয়ে গিয়েছে।
ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে?
না, তা হয়নি বটে, তবে—
তবে কি?
ওরা বছরখানেক হল আলাদা ভাবে বসবাস করছে।
হুঁ। আর চিরঞ্জীব কাঞ্জিলাল? তার কোন সংবাদ পেলেন?
আপনার অনুমানই ঠিক। চায়না টাউন হোটেলের মালিক লোকটা।
তাহলে লোকটার দুপয়সা আছে বলুন?
কি আশ্চর্য! তা আর নেই? হোটেলটা খুব ভালই চলে। লোকটি সজ্জন সন্দেহ নেই। আর মুরগীর রোস্ট যা করে না, আশ্চর্য, একেবারে যাকে বলে ফার্স্ট ক্লাস, অতি উপাদেয়!
মুরগীর রোস্ট বুঝি খাইয়েছিল আপনাকে?
নিশ্চয়ই। দু-প্লেট ভর্তি।
আমি এবার প্রশ্ন করলাম, দু-প্লেটই খেলেন?
কি আশ্চর্য! দিলে আর খাব না? না মশাই, আমার অত প্রেজুডিস নেই।
তা তো সত্যিই, আগ্রহভরে যখন বিশেষ করে সে দিয়েছে। কিন্তু নির্মলশিববাবু শত্রুশিবিরে গিয়ে ঐ ধরনের প্রেজুডিসটা বর্জন করাই ভাল জানবেন।
কিরীটী শান্ত মৃদুকণ্ঠে কথাগুলো বললে।
কথাটা বলেই কিরীটী আবার পূর্বপ্রসঙ্গে ফিরে এল, আচ্ছা নির্মলশিববাবু, ওভারসিজ লিঙ্কের ম্যানেজার ভদ্রলোকটির চেহারাটা কেমন? মানে বলছিলাম কি, দেখতে শুনতে কেমন? খুব লম্বাচওড়া দৈত্যের মত কি?
কি আশ্চর্য! কই না তো!
তবে কি রকম দেখতে?
রোগা লিকলিকে, একটু আবার খখানা। নাকিসুরে কথা বলে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, একটা চোখও আবার বিশ্রীরকম ট্যারা।
একটা পা খোঁড়া নয়?
খোড়া! কই না তো?
হুঁ। বলুন তো কিরকম চেহারাটা তার ঠিক ঠিক?