সেই সময় খাওয়ার কথা জিজ্ঞাসা করায় বিনয়েন্দ্র বলেছিলেন, রাত্রে আর তিনি কিছু খাবেন না। এক গ্লাস দুধ যেন কেবল গরম করে আঁর শোবার ঘরে রামচরণ রেখে দেয়। প্রয়োজন হলে তাই তিনি খাবেন।
রামচরণ প্রভুর নির্দেশমত এক গ্লাস দুধ গরম করে ল্যাবরেটরী-সংলগ্ন তাঁর শয়নঘরে রেখে শুতে যায়, রাত তখন প্রায় পৌনে বারোটা।
তারপর সে নীচে এসে তার নিজের ঘরে শুতে যায়।
কেন জানি না সেদিন রাত্রি দশটার সময় রাত্রের আহার শেষ করবার পর থেকেই অত্যন্ত ঘুম পাচ্ছিল রামচরণের। অন্যান্য রাত্রে তার চোখে ঘুম আসতে আসতে সেই রাত বারোটা বেজে যায়। অত ঘুম পাচ্ছিল বলেই রামচরণ বোধ হয় বিছানায় গিয়ে শোবার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ে।
অন্যান্য দিন খুব সকালেই তার ঘুম ভাঙ্গে, কিন্তু গতকাল ঘুম ভাঙ্গে তার প্রায় সাড়ে সাতটায়। তাও লছমনের ডাকাডাকিতে।
লছমন এ বাড়িতে পাচকের কাজ করে। ঘুম ভেঙ্গে অত বেলা হয়ে গেছে দেখে সে একটু ভীতই হয়ে পড়ে। কেন না বাবুর খুব ভোরে চা-পানের অভ্যাস। এবং সময়মত প্রভাতী চা না পেলে গালাগালি দিয়ে তিনি ভূত ছাড়াবেন।
লছমনকে জিজ্ঞাসা করে, বাবু তাঁকে ডেকেছেন কিনা চায়ের জন্য।
লছমন বলে, না।
যা হোক তাড়াতাড়ি চা নিয়ে যখন সে উপরে চলেছে, পুরন্দর চৌধুরীর সঙ্গে সিঁড়ির সামনে তার দেখা।
সাহেব, আপনি কখন এলেন? রামচরণ জিজ্ঞাসা করে।
এই আসছি। তোমার বাবু কেমন আছেন?
ভালই। চলুন, বাবু বোধ হয় কাল রাত থেকে ল্যাবরেটরী ঘরেই আছেন।
উভয়ে উপরে এসে দেখে ল্যাবরেটরী ঘরের দরজা ঈষৎ খোলা; যেটা ইতিপূর্বে খোলা থাকতে কেউ দেখেনি। রামচরণ বেশ একটু আশ্চর্যই হয়।
রামচরণ চায়ের কাপ হাতে ল্যাবরেটরী ঘরে প্রবেশ করে, পুরন্দর চৌধুরী বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন।
রামচরণকে শুধু বলে দেন তাঁর আসার সংবাদটা বাবুকে দিতে।
সরাসরি ঢোকেন না তিনি ল্যাবরেটরীতে, কেননা সংবাদ না দিয়ে ও অনুমতি না নিয়ে যে ল্যাবরেটরী ঘরে একমাত্র রামচরণ ব্যতীত এ বাড়ির কারুর প্রবেশ করবার হুকুম ছিল না সেটা পুরন্দরের অজানা ছিল না।
বারান্দার ঘরের সামনে দোতলায় পুরন্দর চৌধুরী দাঁড়িয়েছিলেন; হঠাৎ একটা কাঁচ ভাঙার ঝনঝন শব্দ ও আর্তকণ্ঠের চিৎকার তাঁর কানে এল।
কী হল?
ল্যাবরেটরীর ভিতর থেকে আবার রামচরণের চাপা আর্তস্বর শোনা গেল। এবং পুরন্দর চৌধুরী কিছু বুঝে উঠবার আগেই খোলা দরজাপথে একপ্রকার ছুটতে ছুটতেই বের হয়ে এল রামচরণ। তার সর্বাঙ্গ তখন থরথর করে কাঁপছে।
কী! কী হয়েছে রামচরণ? পুরন্দর চৌধুরী প্রশ্ন করেন।
বাবু–বাবু বোধ হয় মরে গেছেন!
.
০৮.
কি বলছ রামচরণ! বাবু মরে গেছেন কি! .
হ্যাঁ। আসুন, দেখবেন চলুন।
পুরন্দর চৌধুরী সোজা ঘরের মধ্যে ছুটে যান। প্রথমটায় তাঁর কিছুই চোখে পড়ে না। ল্যাবরেটরী ঘরের সব কটা জানলাই বন্ধ। এবং জানলার উপর সব ভারি কালো পর্দা ফেলা। সাধারণতঃ ল্যাবরেটরী ঘরে যে উজ্জ্বল হাজার পাওয়ারের বিদ্যুৎবাতি জ্বলে, তখনও ঘরে সে আলোটা জ্বলছে। আর কাজ করবার লম্বা টেবিলটা, যার উপরে নানা ধরনের বিচিত্র সব কাঁচের যন্ত্রপাতি—মাইক্রোসকোপ, বুনসেন বানার প্রভৃতি সাজানো—সেই লম্বা টেবিলটারই সামনে একটা বসবার উঁচু টুলটার পাশেই চিৎ হয়ে পড়ে আছেন বৈজ্ঞানিক বিনয়েন্দ্র সান্ন্যালের নিথর নিস্পন্দ দেহটা।
পরিধানে তখনও তাঁর পায়জামা ও গবেষণাগারের সাদা অ্যাপ্রন। ভূপতিত নিষ্কম্প দেহটা এবং তাঁর মুখের দিকে দৃষ্টিমাত্রেই বুঝতে কষ্ট হয় না যে, সে দেহে প্রাণের লেশমাত্রও আর নেই।
বহুক্ষণ পূর্বেই তাঁর দেহান্ত ঘটেছে। এবং সমস্ত মুখখানা হয়ে গেছে নীলাভ। আতঙ্কিত, বিস্ফারিত দুটি চক্ষুতারকা। ঈষৎ বিভক্ত ও প্রসারিত নীলাভ দুটি ওষ্ঠের প্রান্ত দিয়ে ক্ষীণ একটা রক্তাক্ত ফেনার ধারা গড়িয়ে নেমেছে।
দুটি হাত মুষ্টিবদ্ধ।
মৃতদেহের পাশেই তখনও পড়ে রয়েছে একটি গ্লাস-বিকার। সেই গ্লাস-বিকারের তলদেশে তখনও সাদা মত কী সামান্য খানিকটা তরল পদার্থ অবশিষ্ট পড়ে আছে।
প্রথম দর্শনেই ব্যাপারটা মনে হবে বিনয়েন্দ্র যেন কিছু খেয়ে আত্মহত্যা করেছেন।
পুরন্দর চৌধুরীই দারোয়ান ধনবাহাদুরের হাতে চিঠি দিয়ে স্থানীয় থানায় সংবাদ প্রেরণ করেন। সংবাদ পাওয়ামাত্রই থানা-ইনচার্জ রামানন্দ সেন চলে আসেন। নীলকুঠিতে এসে ব্যাপারটা তদন্ত করে এবং মৃতদেহ পরীক্ষা করে থানা-ইনচার্জের মনে যেন কেমন একটা খটকা লাগে। তিনি তাড়াতাড়ি থানার এ.এস.আই-কে একটা সংবাদ পাঠান, লালবাজার স্পেশাল ব্রাঞ্চে ফোন করে তখুনি ব্যাপারটা জানাবার জন্য।
মৃত্যুর ব্যাপারটা যে ঠিক সোজাসুজি আত্মহত্যা নয়, তিনটি কারণে থানা-ইনচার্জের সন্দেহ হয়েছিল। প্রথমত ঘাড়ের ঠিক নীচেই ১—১২x পরিমাণ একটি কালসিটার চিহ্ন ছিল। দ্বিতীয়ত সুদৃশ্য টেবিল-টাইম-পিষ্ট ভগ্ন অবস্থায় ঘরের মেঝেতে পড়ে ছিল এবং তৃতীয়ত ল্যাবরেটারীর ঘরের দরজাটা ছিল খোলা।
ঘণ্টা দুইয়ের মধ্যে বেলা দশটা নাগাদ ইন্সপেক্টার মিঃ বসাক লালবাজার থেকে চলে আসেন।
থানা-ইনচার্জ তখন নীলকুঠির সমস্ত লোকদের নীচের একটা ঘরে জড়ো করে পুলিস-প্রহরায় একজন একজন করে পাশের ঘরে ডেকে নিয়ে জেরা করছেন।