সকলে এক-একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন।
রজতই প্রথমে কথা বললে।
মিঃ বসাক তাঁর ডায়েরীতে রজতবাবু সম্পর্কে যা লিখেছিলেন তা হচ্ছে রজতবাবুর বয়স ত্রিশ-বত্রিশের মধ্যে। বেশ বলিষ্ঠ দোহারা গঠন। গায়ের রং কালো। চোখে মুখে একটা বুদ্ধির দীপ্তি আছে। এম. এ পড়তে পড়তে পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে লাহোরের একটা মার্চেন্ট অফিসে তাঁর মামার সুপারিসেই চাকরি পেয়ে বছর পাঁচ আগে লাহোরে চলে যান। রজতবাবুর মামা লাহোরের সেই অফিসেই উচ্চপদস্থ একজন কর্মচারী ছিলেন।
কিন্তু গত বছর দুয়েক হল রজতবাবু সে চাকরি ছেড়ে দিয়ে লাহোরে আনারকলি অঞ্চলে একটা ওষুধ ও পারফিউমারীর দোকান নেন এক পাঞ্জাবী মুসলমান বন্ধুর সঙ্গে আধাআধি বখরায়।
মধ্যে মধ্যে প্রায়ই ব্যবসার প্রয়োজনে কলকাতায় আসতেন বটেতবে কখনও কাকা বিনয়েন্দ্রর সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করেননি বা উত্তরপাড়ায় ইতিপূর্বে কখনও আসেননি।
***
আর সুজাতাদেবী! রজতবাবুর চাইতে বছর চার-পাঁচেক বয়সে ছোটই হবে। দেখতে অপরূপ সুন্দরী। সে বোধ হয় তার অপরূপ সুন্দরী পিতামহী সুরধনী দেবীর চোখ-ঝলসানো রূপের ধারাটাকে বহন করে এনেছিল। চোখে মুখে অদ্ভুত একটা শান্ত নিরীহ সরলতা যেন। সুজাতা লক্ষৌতে চাকরি করছে। বি. এ. পাস। বিবাহ করেনি।
.
০৭.
রজতই প্রথমে কথা বললে, কিন্তু কি করে কি হল কিছুই যে আমি বুঝে উঠতে পারছি না মিঃ বসাক। ছোট্রকার সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে আমাদের কোন যোগাযোগ ছিল না সত্যি বটে, তবে তাঁকে তো ভাল করেই জানতাম। তাঁর মত অমন ধীর স্থির শান্ত চরিত্রের লোককে কেউ হত্যা করতে পারে এ যে কখনও কিছুতেই বিশ্বাস করে উঠতে পারছি না।
মিঃ বসাক মৃদু কণ্ঠে বললেন, বিশ্বাস না করতে পারলেও ব্যাপারটা যে ঘটেছে তা তো অস্বীকার করতে পারবেন না রজতবাবু। তাছাড়া দীর্ঘদিন বিনয়েন্দ্রবাবুর সঙ্গে আপনাদের কোন যোগাযোগ পর্যন্ত ছিল না। তাঁর সম্পর্কে কোন কথাও আপনারা শোনেননি।
তা অবশ্য ঠিক।
এই সময়ের মধ্যে তাঁর কোন পরিবর্তন হয়েছিল কিনা এবং এমন কোন কিছু ঘটেছিল কিনা যেজন্য এই দুর্ঘটনা ঘটল তাও তো আপনি বলতে পারেন না।
তা অবশ্য পারি না।
আচ্ছা পুরন্দরবাবু,–হঠাৎ মিঃ বসাক পাশ্বেই উপবিষ্ট পুরন্দর চৌধুরীর দিকে ফিরে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, আপনিই তো তাঁর বিশেষ বন্ধু ছিলেন, তাঁর সম্পর্কে কোন কিছু আপনি জেনেছিলেন?
না। He was a perfect gentleman। গম্ভীর কণ্ঠে প্রত্যুত্তর দিলেন পুরন্দর চৌধুরী।
এবারে আবার মিঃ বসাক রজতের দিকে ফিরে তাকিয়ে বললেন, আমি লালবাজার থেকে এসে পৌঁছবার আগেই এখানকার থানা-ইনচার্জ রামানন্দবাবু যতটা সম্ভব তদন্ত করেছিলেন। তাঁর রিপোর্ট থেকে যতটা জানতে পেরেছি, বিনয়েন্দ্রবাবু নাকি ইদানীং সাত আট বছর অত্যন্ত secluded life lead করতেন। দিবারাত্র তাঁর ল্যাবরেটরী ঘরের মধ্যেই কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। পাড়ার কারোর সঙ্গেই তাঁর বড় একটা মেলামেশা ছিল না। আশপাশের ভদ্রলোকেরা কেউ তাঁর সম্পর্কে কোন কথা বলতে পারেননি। একজন ভদ্রলোক তো বললে, লোকটা যে বাড়িতে থাকে তাই জানবার উপায় ছিল না।
ঐ সময় রামচরণ চায়ের ট্রে হাতে ঘরে এসে প্রবেশ করল।
রজত রামচরণের দিকে তাকিয়ে মিঃ বসাককে সম্বোধন করে বললে, রামচরণ তো এ বাড়ির অনেকদিনকার পুরনো চাকর। ওকে জিজ্ঞাসা করেননি? ও হয়তো অনেক কথা বলতে পারবে।
হ্যাঁ, রামচরণের কাছে কিছু কিছু information পেয়েছি বটে তবে সেও অত্যন্ত এলোমেলো।
রামচরণ একবার রজতের মুখের দিকে তাকাল। কিন্তু কোন কথা না বলে চায়ের কাপগুলো একটার পর একটা টেবিলের উপরে নামিয়ে রেখে নিঃশব্দে ঘর থেকে যেমন এসেছিল তেমনি বের হয়ে গেল।
চা পান করতে করতে মিঃ বসাক আবার বলতে লাগলেন।
.
প্রথম ভোরের লোকাল ট্রেনে পুরন্দর চৌধুরী বিনয়েন্দ্রবাবুর একটা জরুরী চিঠি পেয়ে এখানে এসে পৌঁছান। পুরন্দর চৌধুরী আসছেন সিঙ্গাপুর থেকে। ভোরবেলায় তিনি প্লেনে করে কলকাতা এসে পৌঁছান এবং সোজা একেবারে ট্যাক্সিতে করে অন্য কোথায়ও না গিয়ে উত্তরপাড়ায় চলে আসেন।
ইতিপূর্বে অবশ্য পুরন্দর চৌধুরী বার তিন-চার এ বাড়িতে এসেছেন, তিনি নিজেও তা স্বীকার করেছেন এবং রামচরণও বলেছে।
পুরন্দর চৌধুরী এককালে কলেজ লাইফে বিনয়েন্দ্রর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তারপর বি.এস-সি পরীক্ষায় ফেল করে কাউকে কিছু না জানিয়ে জাহাজে খালাসীর চাকরি নিয়ে সিঙ্গাপুরে চলেযানভাগ্যান্বেষণে। এখনও সেখানেই আছেন। পুরন্দরচৌধুরী এখানে এসে নিচেরামচরণের দেখা পান। রামচরণকেই জিজ্ঞাসা করেন তার বাবু কোথায়।
রামচরণ ঐ সময় প্রভাতী চা নিয়ে বাবুর ল্যাবরেটরীর দিকেই চলেছিল। সে বলে, গত রাত থেকে বাবু ল্যাবরেটরীতেই কাজ করছেন। এখনও বের হননি।
এ রকম প্রায়ই নাকি মধ্যে মধ্যে সারাটা রাত বিনয়েন্দ্র ল্যাবরেটরীতেই কাটিয়ে দিতেন।
সকলের উপরে কঠোর নির্দেশ ছিল বিনয়েন্দ্র যতক্ষণ ল্যাবরেটরীতে থাকবেন কেউ যেন তাঁকে কোন কারণেই না বিরক্ত করে। সেইজন্যই রামচরণ সেরাত্রে তাঁকে বিরক্ত করেনি।
রামচরণের জবানবন্দি থেকেই জানা যায়, গত রাত্রে এগারোটা নাগাদ একবার নাকি ল্যাবরেটরী থেকে বের হয়েছিলেন বিনয়েন্দ্র।