তার করেছেন?
হ্যাঁ। এ বাড়িতে গত রাত্রে যে দুর্ঘটনা ঘটেছে।
আমরা শুনেছি।
আপনারা শুনেছেন! শুনেছেন যে বিনয়েন্দ্রবাবু–
হ্যাঁ শুনেছি। বাইরে গেটের সামনে যে পুলিস প্রহরীটি আছে তার মুখেই শুনেছি। কিন্তু আমরা তো কাকার জরুরী চিঠি পেয়েই আসছি।
জরুরী চিঠি পেয়ে—মানে বিনয়েন্দ্রবাবুর চিঠি পেয়ে?
হ্যাঁ।
আশ্চর্য! আপনারাও কি তাহলে ওঁরই মত বিনয়েন্দ্রবাবুর চিঠি পেয়েই আসছেন নাকি? সত্যিই বিচিত্র ব্যাপার দেখছি! মিঃ বসাক বললেন।
হ্যাঁ।
যাক। তাহলে আমি একাই নয়। আপনারাও আমার দলে আছেন। কথাটা বললেন এবার পুরন্দর চৌধুরী।
সকলে আবার পুরন্দর চৌধুরীর দিকে ফিরে তাকালেন!
কই, কী চিঠি পেয়েছেন দেখি, আছে আপনাদের কাছে সে চিঠি?
হ্যাঁ।
রজতই প্রথমে তার পকেট থেকে চিঠিটা বের করে দিতে দিতে সুজাতার দিকে তাকিয়ে বললে, তোর চিঠিটা আছে তো?
হুঁ, এই যে। বলতে বলতে সুজাতাও তার ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটা মুখছেড়া খামসমেত চিঠি বের করে মিঃ বসাকের হাতে তুলে দিল।
বারান্দার অল্প আলোতেই দুখানা চিঠি পর পর পড়লেন মিঃ বসাক। তারপর আবার মৃদু কণ্ঠে বললেন, আশ্চর্য! একই ধরনের চিঠি, একেবারে হুবহু এক।
নিন, থাকুন এবারে এখানে আমার মতই নজরবন্দী হয়ে। পুরন্দর চৌধুরী আবার কথা বললেন।
মিঃ বসাক কিন্তু পুরন্দর চৌধুরীর ওই ধরনের কথায় মুখে কোনরূপ মন্তব্য না করলেও একবার তীব্র দৃষ্টিতে পুরন্দর চৌধুরীর দিকে তাকালেন, তারপর আবার ওদের দিকে ফিরে তাকিয়ে বললেন, আপনাদের সঙ্গে কোন জিনিসপত্র আনেননি রজতবাবু?
বিশেষ কিছু তো সঙ্গে আনিনি, ওর একটা আর আমার একটা বেডিং ও দুজনের দুটো সুটকেস।
সেগুলো কোথায়?
বাইরে দারোয়ানের ছোট ঘরটাতেই রেখে এসেছি।
ঠিক আছে। আসুন, আপাততঃ আমার ঐ ঘরেই।
মিঃ বসাক ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন, রজত ও সুজাতা তাঁকে অনুসরণ করল এবং পুরন্দরবাবুকে কিছু না বলা সত্ত্বেও তিনিও ওদের সঙ্গে সঙ্গেই অগ্রসর হলেন।
দরজার কাছাকাছি যেতেই একজন প্রৌঢ় ব্যক্তিকে বারান্দার অপর প্রান্ত থেকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল।
এই যে রামচরণ! শোন, এদিকে এস।
ঐ প্রৌঢ়ই এ বাড়ির পুরাতন ভৃত্য রামচরণ।
০৬-১০. রামচরণ মাত্র আঠারো বছর বয়সে
রামচরণ মাত্র আঠারো বছর বয়সে এ বাড়িতে এসে চাকরি নিয়েছিল অনাদি চক্রবর্তীর কাছে। বাড়ি তার মেদিনীপুরে। দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছর তার এ বাড়িতে কেটে গেছে। ষাটের উদ্ধে বর্তমানে তার বয়স হলেও একমাত্র কেশে পাক ধরা ছাড়া দেহের কোথাও বার্ধক্যের দাঁত বসেনি। বেঁটেখাটো বেশ বলিষ্ঠ গঠনের লোক। পরিধানে একটা পরিষ্কার সাদা ধুতি ও সাদা মেজাই। কাঁধে একটা পরিষ্কার ভোয়ালে।
রামচরণ মিঃ বসাকের ডাকে এগিয়ে এসে বললে, আমাকে ডাকছিলেন ইন্সপেক্টারবাবু?
হ্যাঁ। তোমার চা হল?
জল ফুটে গেছে, এখুনি নিয়ে আসছি।
এঁদের জন্যেও চা নিয়ে এস, এঁদের বোধ হয় তুমি চিনতে পারছ না?
আজ্ঞে না তো।
এঁরা তোমার কাবাবুর ভাইপো ও ভাইঝি। উপরে এঁদের থাকবার ব্যবস্থা করে দাও। আর হ্যাঁ, দেখ, বাইরে দারোয়ানের ঘরে এঁদের জিনিসপত্র আছে, সেগুলো মালীকে দিয়ে ভিতরে আনাবার ব্যবস্থা কর।
যে আজ্ঞে—
রামচরণ বোধ হয় আজ্ঞা পালনের জন্যই চলে যাচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎ সুজাতার কথায় থমকে দাঁড়াল।
সুজাতা বলছিল, কিন্তু আমি তো এখানে থাকতে পারব না ছোড়দা, আমি কলকাতায় যাব।
মিঃ বসাক ফিরে তাকালেন সুজাতার দিকে তার কথায়, কেন বলুন তো সুজাতাদেবী?
না না—আমি এখানে থাকতে পারব না, আমার যেন কেমন দম বন্ধ হয়ে আসছে। ছোড়া, আমি কলকাতায় যাব।
কেমন যেন ভীত শুষ্ক কণ্ঠে কথাগুলো বলে সুজাতা।
মিঃ বসাক হাসলেন, বুঝতে পারছি সুজাতাদেবী, আপনি একটু নার্ভাস হয়ে পড়েছেন। কিন্তু ভয়ের কিছু নেই, আমিও আজকের রাত এখানেই থাকব, কলকাতায় ফিরে যাব না। তাছাড়া এই রাত্রে কলকাতায় গিয়ে সেই হোটেলেই তো উঠবেন। তার চাইতে আজকের রাতটা এখানেই কাটান না, কাল সকালে যা হয় করবেন।
হ্যাঁ। সেই ভাল সুজাতা। রজত বোঝাবার চেষ্টা করে।
না ছোড়দা, কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে। থাকতে হয় তুমি থাক, আমি কলকাতায় ফিরেই যাব। সুজাতা আবার প্রতিবাদ জানায়।
তা যেতে হয় যাবেনখন। আবার বললেন মিঃ বসাক।
এবার সুজাতা চুপ করেই থাকে।
কিন্তু আজকের রাতটা সত্যিই থেকে গেলে হত না সুজাতা? রজত বোঝাবার চেষ্টা করে।
না–
শোন্ একটা কথা বলে রজত সুজাতাকে একপাশে নিয়ে যায়।
কী?
তোর যাওয়াটা বোধ হয় এক্ষুনি উচিত হবে না।
কেন?
কাকার কি করে মৃত্যু হল সেটাও তো আমাদের জানা প্রয়োজন। তাছাড়া আমি রয়েছি, আরও এত পুলিসের লোক রয়েছে–ভয়টাই বা কি?
না ছোড়দা—
যেতে হয় কাল সকালেই না হয় যাস। চল–
ঐ সময় মিঃ বসাকও আবার বললেন, চলুন, ঘরে চলুন। শুধু আমরাই নয় মিস রয়, এ বাড়ি ঘিরে আট-দশজন পুলিস প্রহরীও আছে এবং সারা রাতই তারা থাকবে।
.
সকলে এসে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলেন।
এ ঘরের সাইজটাও নেহাত ছেট নয়। বেশ প্রশস্তই। চারিদিকে চেয়ে মনে হল ঘরটা ইদানীং খালিই পড়ে থাকত। একটা টেবিল ও এদিক-ওদিক খানকতক চেয়ার ও একটা আরাম-কেদারা ছাড়া ঘরের মধ্যে অন্য কোন আসবাবপত্রই আর নেই।
ঘরের আলোটা কম শক্তির নয়। বেশ উজ্জ্বলই। টেবিলের উপরে একটা সিগারেটের টিন, একটা দেশলাই ও একটা ফ্ল্যাট ফাইল পড়ে ছিল। মিঃ বসাক রজতের দিকে তাকিয়ে বললেন, বসুন রজতবাবু, বসুন সুজাতাদেবী। পুরন্দরবাবু বসুন।