অন্য দিকে কয়েকটা পুরাতন আমলের রচটা, ভেলভেটের গদীমোড়া মলিন ভারি কারুকার্য করা সেগুন কাঠের তৈরী কাউচ।
দেওয়ালে বড় বড় কয়েকটি অয়েল-পেন্টিং।
চোগাচাপকান পরিহিত ও মাথায় পাগড়ি-আঁটা পুরুষের প্রতিকৃতি এগুলিচক্রবর্তীদের স্বনামধন্য সব পূর্বপুরুষদেরই প্রতিকৃতি বলেই মনে হচ্ছে।
মাথার উপরে সিলিং থেকে দোদুল্যমান বেলোয়ারী কাঁচের সেকেলে ঝাড়বাতি। তবে আগে হয়তো এককালে সেই সব বাতিদানের মধ্যে জ্বলত মোমবাতি, এখন জ্বলছে মাত্র দুটি অল্পশক্তির বিদ্যুৎবাতি। যাতে করে অত বড় হলঘরটায় আলোর খাঁকতি ঘটেছে।
স্বল্প আলোয় সর্বত্র যেন একটা ছমছমে ভাব। ঘরের মধ্যে কেউ নেই।
শুধু ঘরের মধ্যে কেন, এত বড় বিরাট নীলকুঠিটার মধ্যে কেউ আছে বলেই মনে হয়। কোন পরিত্যক্ত কবরখানার মতই একটা যেন মৃত্যুশীতল স্তব্ধতা সমস্ত বাড়িটার মধ্যে চেপে বসেছে।
এ বাড়িতে রজত বা সুজাতা ইতিপূর্বে একবারও আসেনি। অপরিচিত সব কিছু। দুজনে কিছুক্ষণ হলঘরটার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর আবার একসময় সামনের ভেজানো দরজাটা খুলে অন্দরের দিকে পা বাড়ায়!
লম্বা একটা দীর্ঘ টানা বারান্দা। নির্জন খাঁ-খাঁ করছে।
এখানেও একটি স্বল্প শক্তির বিদ্যুবাতির জন্য রহস্যময় একটা আলোছায়ার থমথমে ভাব। বারান্দায় প্রবেশ করে রজত একবার চারিদিকে তার চোখের দৃষ্টিটা বুলিয়ে নিল। ঘরের মত সেই বারান্দাটাও শূন্য। এবং হঠাৎ তার নজরে পড়ল বারান্দার মাঝামাঝি জায়গায় অর্ধেক ভেজানো একটা দ্বারপথে ঘরের মধ্যকার একটা ক্ষীণ আলোর আভাস আসছে।
সেই ঘরের দিকেই এগুবে কিনা রজত ভাবছে, এমন সময় অল্প দূরে সামনেই দোতলায় উঠবার সিঁড়িতে ভারী জুতোর মচমচ শব্দ শোনা যেতেই উভয়েরই দৃষ্টি সেই দিকে গিয়ে নিবদ্ধ হল।
প্রশস্ত সিঁড়ি।
০৫.
সিঁড়ির খানিকটা দেখা যাচ্ছে, তারপরেই বাঁয়ে বাঁক নিয়ে উপরে উঠে গেছে বোঝা যায় সিঁড়িটা। মচমচ ভারি জুতোের শব্দটা আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে নীচেই নেমে আসছে মনে হল।
আপাততঃ ওরা দুজনেই উদগ্রীব হয়ে শব্দটাকে লক্ষ্য করে ঐদিকেই তাকিয়ে থাকে। ক্রমে বারান্দায় অল্প আলোয় ওদের নজরে পড়ল দীর্ঘকায় এক পুরুষ মূর্তি।
পুরুষ মূর্তিটিই জুতোর শব্দ জাগিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছেন।
.
আগন্তুক দৈর্ঘ্যে প্রায় ছ ফুট হবেন।
পরিধানে মুসলমানী চোস্ত পায়জামা, গায়ে কালো সার্জের গলাবন্ধ স্কুল সরওয়ানী। পায়ে কালো ডার্বী জুতো। মুখখানি লম্বাটে ধরনের। কালো ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। সরু গোঁফ। মাথার চুল ঘন কুঞ্চিত, চোখে সরু ফ্রেমের চশমা। হাতে একটি মোটা লাঠি। লাঠিটা ডান হাতে ধরে উঁচু করে নামছিলেন ভদ্রলোক।
হঠাৎ সিঁড়ির নীচে অল্প দূরেই দণ্ডায়মান ওদের দুজনের দিকে নজর পড়তেই নামতে নামতে সিঁড়ির মাঝখানেই দাঁড়িয়ে পড়লেন। এক হাতে লাঠিটা ধরে ওদের দিকে তাকালেন। চশমার লেন্সের ভিতর দিয়ে চোখের দৃষ্টিজোড়া যেন ওদের সর্বাঙ্গ লেহন করতে লাগল।
ওরাও নিঃশব্দে দণ্ডায়মান আগন্তুকের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
কোন পক্ষ থেকেই কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। কয়েকটা মুহূর্ত কেটে গেল এমনি। হঠাৎ এমন সময় সেই স্তব্ধটার মধ্যে একটা পুরুষের কণ্ঠস্বর পশ্চাৎ দিক থেকে শুনতে পেয়েই রজত ঘুরে ফিরে তাকাল পশ্চাতের দিকে।
এ কি! পুরন্দরবাবু, কোথায় বের হচ্ছেন?
দ্বিতীয় আগন্তুককে দেখা মাত্রই রজতের বুঝতে কষ্ট হয় না তিনি কোন পুলিসের লোক। পরিধানে চিরন্তন পুলিসের পোশাক। লংস ও হাফসাট, কাঁধে পুলিসের ব্যাজ।
হ্যাঁ। একটু বাইরে থেকে ঘুরে না এলে মারা পড়ব, মিঃ বসাক।
পুরন্দরবাবুর প্রত্যুত্তরে পুলিস অফিসার মিঃ বসাক বললেন, কিন্তু আপনাকে তো সকালবেলাতেই বলে দিয়েছিলাম, আপাততঃ investigationশেষ না হওয়া পর্যন্ত আপনাদের কারোরই কোথাও এ বাড়ি থেকে বের হওয়া চলবে না মিঃ চৌধুরী।
বেশ রুক্ষ ও কর্কশ কঠেই এবারে পুরন্দর চৌধুরী প্রত্যুত্তর দিলেন, কিন্তু কেন বলুন তো? এ আপনাদের অন্যায় জুলুম নয় কী?
অন্যায় জুলুম বলছেন?
নিশ্চয়ই। আপনাদের কি ধারণা তাহলে আমিই বিনয়েন্দ্রকে হত্যা করেছি?
সে কথা তো আপনাকে আমি বলিনি।
তবে? তবে এভাবে আমাকে বাড়ির মধ্যে নজরবন্দী করে রাখবার মানেটা কী? কী উদ্দেশ্য বলতে পারেন?
উদ্দেশ্য যাই হোক, আপনাকে যেমন বলা হয়েছে তেমনি চলবেন।
আর যদি না চলি?
পুরন্দরবাবু, আপনি ছেলেমানুষ নন, জেনেশুনে আইন অমান্য করবার অপরাধে যে আপনাকে পড়তে হবে সেটা ভুলে যাবেন না।
বলেই যেন সম্পূর্ণ পুরন্দর চৌধুরীকে উপেক্ষা করে এবারে মিঃ বসাক দণ্ডায়মান রজত ও সুজাতার দিকে ফিরে তাকালেন।
বারান্দায় প্রবেশ করা মাত্রই ওদের প্রতি নজর পড়েছিল মিঃ বসাকের, কিন্তু পুরন্দর চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলবার জন্যে ওদের সঙ্গে এতক্ষণ কথা বলেননি বোধ হয়।
এবারে ওদের দিকে তাকিয়ে মৃদুকণ্ঠে বললেন, আপনারা?
রজত সংক্ষেপে নিজের ও সুজাতার পরিচয় দিল, আমি আর সুজাতা এই এখুনি আসছি।
কিন্তু আপনারা এত তাড়াতাড়ি এলেন কি করে?
কি বলছেন আপনি মিঃ বসাক? রজত প্রশ্ন করে।
মানে আমি বলছিলাম, আজই তো বেলা দশটা নাগাদ আপনাদের দুজনকে আসবার জন্য তার করেছি।