আমরা জানি অনাদি চক্রবর্তী তাঁর পিতার একমাত্র সন্তানই ছিলেন। কিন্তু আসলে তা নয়। তাঁর একটি ভগ্নীও ছিল। নাম প্রেমলতা।
প্রেমলতার তেরো বছর বয়সের সময় বিবাহ হয় এবুং মোল বৎসর বয়সে সে যখন বিধবা হয়ে ফিরে এল পিতৃগৃহে তখন তার কোলে একমাত্র শিশুপুত্র, বয়স তার মাত্র দুই। প্রেমলতা অনাদি চক্রবর্তীর থেকে আঠারো বছরের ছোট ছিল। মধ্যে আরো দুটি সন্তান অনাদির মার হয়, কিন্তু তারা আঁতুড় ঘরেই মারা যায়। প্রেমলতা বিনয়েন্দ্রর মার থেকে বয়সে বছর চারেকের বড় ছিল। বিধবা হয়ে পিতৃগৃহে ফিরে আসবার বছর খানেকের মধ্যে সহসা এক রাত্রে প্রেমলতা তার শিশুপুত্রসহ গৃহত্যাগিনী হয়। এবং কুলত্যাগ করে যাওয়ার জন্যই অনাদি চক্রবর্তী তার নামটা পর্যন্ত চক্রবর্তী বংশের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলেন। কিন্তু জোর করে মুছে ফেললেই আর সব-কিছু মুছে ফেলা যায় না।
যা হোক, গৃহত্যাগিনী প্রেমলতার পরবর্তী ইতিহাস খুঁজে না পাওয়া গেলেও তাঁর শিশু পুত্রটির ইতিহাস খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। এক অনাথ আশ্রমে সেই শিশু মানুষ হল বটে, তবে কুলত্যাগিনী মায়ের পাপ য়ে তার রক্তে ছিল! সেই পাপের টানেই সেই শিশু যতই বড় হতে লাগল তার মাথার মধ্যে শয়তানী বুদ্ধিটাও তত পরিপক্ক হতে লাগল।
সেই শিশুঁকেই পরবর্তীকালে আমরা দেখছি পুরন্দর চৌধুরী রূপে। পুরন্দর চৌধুরী তাঁর যে জীবনের ইতিবৃত্ত দিয়েছিল তা সর্বৈব মিথ্যা, কাল্পনিক। নিজের সত্যিকারের পরিচয়টা পুরন্দর চৌধুরী জানত, কিন্তু তা সত্বেও কোনদিন সাহস করে গিয়ে তার মামা অনাদি চক্রবর্তীর সামনে দাঁড়াতে পারেনি। কারণ, সে জানত অনাদি চক্রবর্তী কোনদিনই তাকে ক্ষমার চোখে দেখবেনই না, এমন কি সামনে গেলে দূর করেই হয়ত তাড়িয়ে দেবেন।
তাই কলেজ অধ্যয়নকালে সহপাঠী বিনয়েন্দ্রর সঙ্গে যখন তার পরিচয় হয় তখন থেকেই। বিনয়েন্দ্রর প্রতি একটা হিংসা পোষণ করতে শুরু করে পুরন্দর এবং সে হিংসায় নতুন করে ইন্ধন পড়ে লতা সিংয়ের প্রেমের প্রতিদ্বন্দিতায়।
পুরন্দর চৌধুরী অনাদি চক্রবর্তীর সঙ্গে বিনয়েন্দ্রর কোন সম্পর্ক নেই জেনে প্রথমে যেটুকু নিশ্চিন্ত হয়েছিল, পরে অনাদি চক্রবর্তীর মৃত্যুর পর যখন সে জানতে পারল বিনয়েন্দ্রকেই অনাদি তার সমস্ত সম্পত্তি দিয়ে গিয়েছেন তখন থেকেই সে নিশ্চিন্ত ভাবটা তো গেলই, ঐসঙ্গে বিনয়েন্দ্রর প্রতি আক্রোশটা আবার নতুন করে দ্বিগুণ হয়েজেগে ওঠে। এবং প্রকৃতপক্ষে তখন থেকেই মনে মনে বিনয়েন্দ্রকে হত্যা করবার পরিকল্পনা করতে থাকে পুরন্দর। কিন্তু এ সময় কিছু দিনের জন্য ভাগ্যচক্রে তাকে সিঙ্গাপুরে ভাগ্যান্বেষণে যেতে হওয়ায় ব্যাপারটা চাপা পড়ে থাকে মাত্র। তবে ভোলেনি সে কথাটা। বিনয়েন্দ্রকে কোন মতে পৃথিবী থেকে সরাতে পারলে সে-ই হবে অনাদি চক্রবর্তীর সম্পত্তির অন্যতম ওয়ারিশন তাও সে ভুলতে পারেনি কোনদিন। আর তাই সে কিছুতেই নীলকুঠির মায়া ত্যাগ করতে পারেনি। নীলকুঠিতে পুরন্দর ছায়াকুহেলীর সৃষ্টি করে। তার ইচ্ছা ছিল, ঐ ভাবে একটা ভৌতিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে পরে কোন এক সময় সুযোগ মত বিনয়েন্দ্রকে হত্যা করবে। সেই মতলবই ধীরে ধীরে পুরন্দর তার পরিকল্পনা মত এগুচ্ছিল।
এদিকে একদা যৌবনের বাঞ্ছিতা লতাকে পৌঢ়ত্বের সীমানায় এসে হঠাৎ আবার নতুন করে কাছে পেয়ে বিনয়েন্দ্র পাগল হয়ে উঠল। এবং অন্যদিকে আকস্মিকভাবে আবার একদিন। রাত্রে বহুকাল পরে পুরন্দরকে দেখে লতা বুঝতে পারল যৌবনের সে-ভালবাসাকে আজও সে ভুলতে পারেনি। এবং সেই ভালবাসার টানেই পুরন্দরের পরামর্শে তার দুষ্কৃতির সঙ্গে হাতে হাত মেলাল লতা। পরে অবিশ্যি ধরা পড়ে, মুক্তির আর কোন উপায়ই নেই দেখে অনন্যোপায় লতা আত্মহত্যা করে তার ভুলের ও সেই সঙ্গে প্রেমের প্রায়শ্চিত্ত করল।
কিন্তু বলছিলাম পুরন্দর চৌধুরীর কথা। কেন সে সুজাতা ও রজতকে বিনয়েন্দ্রর নামে চিঠি দিয়ে অত তাড়াতাড়ি নীলকুঠিতে ডেকে এনেছিল?
কারণ, বিনয়েন্দ্রকে হত্যা করলেই সে সমস্ত সম্পত্তি পাবে না। রজত ও সুজাতা হবে। তার অংশীদার। কিন্তু তাদের সরাতে পারলে তার পথ হবে সম্পূর্ণ নিষ্কণ্টক। তাই সে ওদের হাতের সামনে ডেকে এনেছিল সুযোগ ও সুবিধা মত হত্যা করবার জন্যই।
বিনয়েন্দ্রকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে সে তার সম্পত্তি লাভের প্রথম সোপান তৈরী করেছিল; এখন রজত ও সুজাতাকে হত্যা করতে পারলেই সব ঝামেলাই মিটে যায়। নিরঙ্কুশভাবেই সে ও লতা বিনয়েন্দ্রর সমস্ত সম্পত্তির অধিকারী হয়ে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারে।
কিন্তু ইতিমধ্যেই নিরপরাধিনী স্ত্রী ও তার শিশু পুত্রকে ও বিনয়েন্দ্রকে হত্যা করে যে পাপের বোঝা পূর্ণ হয়ে উঠেছিল তারই অমোঘ দণ্ড যে মাথার উপরে নেমে আসতে পারে, পুরন্দর চৌধুরী বোধ হয় স্বপ্নেও তা ভাবেনি।
সাজানো খুঁটি যে কেঁচে যেতে পারে শেষ মুহূর্তেও তা বোধহয় ধারণাও করেনি পুরন্দর। এমনিই হয়। এবং একেই বলে ভগবানের মার। যাঁর সুক্ষ্ম বিচারে কোন ত্রুটি, কোন ভুল থাকে না। যাঁর নির্মম দণ্ড বজ্রের মতই অকস্মাৎ অপরাধী পাপীর মাথার উপরে নেমে আসে।
নইলে তারই দেওয়া সিঙ্গাপুরী মুক্তা-বিষ খেয়ে লতাকেই বা শেষ মুহূর্তে আত্মহত্যা করে তার মহাপাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে কেন? আর হতভাগ্য পুরন্দর চৌধুরীকেই বা অন্ধকার কারাকক্ষের মধ্যে ফাঁসির প্রতীক্ষ্ণয় দণ্ড পল প্রহর দিন গণনা করতে হবে কেন?