সেই সব অনাদি চক্রবর্তীর কানে যাওয়ায় তিনি তাদের কোনদিনই ভাল চোখে দেখতে পারেননি। এবং সেই কারণেই হয়তো তিনি তাদের বঞ্চিত করে যাবতীয় সম্পত্তি একা বিনয়েন্দ্রকেই দিয়ে গিয়েছিলেন।
উইলটা অনাদি চক্রবর্তী মৃত্যুর পাঁচ বছর আগেই করেছিলেন।
বিনয়েন্দ্র উত্তরপাড়ার নীলকুঠি থেকে আর ফিরলেন না। সবাই আত্মীয়-অনাত্মীয়রা বুঝল এবং বললে, বিষয়-সম্পত্তি উইল অনুযায়ী সেখান থেকে এলে হাতছাড়া হয়ে যাবে বলেই তিনি সেখান থেকে আর এলেন না।
কিন্তু আসলে বিনয়েন্দ্র যে আর নীলকুঠি থেকে ফিরে আসেননি তার একমাত্র কারণ তার মধ্যে ঐ বিরাট সম্পত্তির ব্যাপারটা থাকলেও একমাত্র কারণ কিন্তু তা নয়। অন্য মুখ্য একটা কারণ ছিল।
বহুদিনের ইচ্ছা ছিল তাঁর একটি নিজস্ব ল্যাবরেটারী তৈরী করে নিজের ইচ্ছেমত গবেষণা নিয়ে থাকেন। কিন্তু তার জন্য যে অর্থের প্রয়োজন সেই অর্থ তো তাঁর ছিল না। এখন দাদুর মৃত্যুতে সেই সুযোেগ হাতের মুঠোর মধ্যে আসায় বহুদিনের তাঁর অতৃপ্ত আকাঙ্খটি পূরণ করবার পক্ষে আর কোন বাধাই এখন অবশ্য রইল না। এবং দীর্ঘ তিন বছর পরে আবার সব কথা খুলে বলে তিনি রজতের মাকে একটা দীর্ঘ পত্র দিয়েছিলেন।
কিন্তু রজতের মা সে চিঠি পড়লেন না পর্যন্ত, খাম সমেত ছিড়ে টুকরো টুকরো করে জানলা গলিয়ে বাইরে ফেলে দিলেন।
দিনের পর দিন অপেক্ষা করেও বিনয়েন্দ্র চিঠির কোন জবাব পেলেন না।
আবার চিঠি দিলেন। দ্বিতীয় চিঠিও প্রথম চিঠিটার মতই অপঠিত অবস্থায় শতছিন্ন হয়ে জানলাপথে নিক্ষিপ্ত হল।
দীর্ঘ দুমাস অপেক্ষা করবার পরও যখন সেই দ্বিতীয় চিঠির কোন জবাব এল না, প্রচণ্ড অভিমানে বিনয়েন্দ্র আর ওপথ মাড়ালেন না।
তারপর আরও পাঁচটা বছর কালের বুকে মিলিয়ে গেল।
হঠাৎ একদিন বিনয়েন্দ্র সংবাদ পেলেন, রজত লাহোরে চাকরি নিয়ে তার মাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল, সেখানেই বৌদির মৃত্যু হয়েছে। এবং সুজাতাও তার পরের বছর বি. এ. পাস করে লক্ষ্ণৌয়ে চাকরি নিয়ে চলে গেছে।
একজন লাহোরে, অন্যজন লক্ষ্ণৌতে।
.
০৪.
সন্ধ্যার ঘনায়মান অন্ধকারে রজত আর সুজাতা গঙ্গার ধারে নীলকুঠির লোহার ফটকটার সামনে এসে সাইকেল-রিকশা থেকে নেমে এবং রিকশার ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে গেট দিয়ে ঢুকতে যাবে এমন সময় হঠাৎ বাধা পেয়ে তাদের দাঁড়াতে হল।
দাঁড়ান।
গেটের সামনে বাধা দিয়েছিল একজন লাল-পাগড়ি-পরিহিত কনস্টেবল।
কে আপনারা, কী ব্যাপার! দুজনেই থমকে দাঁড়ায়।
কোথা থেকে আসছেন?
রজত বললে, আমার নাম রজত সান্যাল আর ইনি আমার বোন সুজাতা সান্যাল। আমি আসছি লাহোর থেকে আর আমার বোন লক্ষ্ণৌ থেকে।
ও, তা এ বাড়ির মালিক—বিনয়েন্দ্র সান্যাল।
রজত আবার বললে, আমাদের কাকা।
বিনয়েন্দ্রবাবু তাহলে—
বললাম তো আমাদের কাকা।
আপনারা তাহলে কি কিছুই জানেন না?
কিছু জানি না মানে! কি জানি না?
গেটের সামনেই ঢোকার মুখে পুলিস কর্তৃক বাধা পেয়েই মনের মধ্যে উভয়েরই একটা অজানিত আশঙ্কা জাগছিল। এখন পুলিস প্রহরীদের কথায় সে আশঙ্কাটা যেন আরও ঘনীভূত হয়।
এ বাড়ির কত কাল রাতে খুন হয়েছেন।
অ্যাঁ! কি বললে? যুগপৎ একটা অস্ফুট আর্ত চিৎকারের মতই যেন একই মুহূর্তে দুজনের কণ্ঠ হতে কথাটা উচ্চারিত হল।
সংবাদটা শুধু আকস্মিকই নয়, অভাবনীয়।
হ্যাঁ বাবু, বড় দুঃখের বিষয়। এ বাড়ির কর্তাকে কাল রাত্রে কে যেন খুন করেছে।
রজত বা সুজাতা দুজনের একজনের ওষ্ঠ দিয়েও কথা সরে না। দুজনেই বাক্যহারা, বিস্মিত, স্তম্ভিত।
ভিতরে যান, ইন্সপেক্টারবাবু আছেন।
কিন্তু কি বলছ তুমি, আমি যে কিছুই মাথামুণ্ডু বুঝতে পারছি না। এ বাড়ির কর্তা নিহত হয়েছেন মানে? রজত কোনমতে প্রশ্নটা করে।
পুলিস প্রহরীটি মৃদু কণ্ঠে বললে, সেই জন্যই তো বাড়িটা পুলিসের প্রহরায় আছে। যান, ভিতরে যান, ভিতরে দারোগাবাবু আছেন, তাঁর কাছেই সব জানতে পারবেন।
কিন্তু পা যেন আর চলে না।
অতর্কিত একটা বৈদ্যুতিক আঘাতে যেন সমস্ত চলচ্ছক্তি ওদের লোপ পেয়ে গেছে! এই চরম দুঃসংবাদের জন্যেই কি তারা এই দীর্ঘপথ অতিক্রম করে এল পত্র পাওয়া মাত্রই!
গেট পার হবার পর পায়ে-চলা একটা লাল সুরকি-ঢালা রাস্তা। শেষ হয়েছে গিয়ে সেটা প্রশস্ত একটা গাড়িবারান্দার নীচে।
গাড়িবারান্দায় উঠলেই সামনে যে হলঘরটা সেটাই বাইরের ঘর।
হলঘরের দরজাটা খোলা এবং সেই খোলা দরজা-পথে একটা আলোর ছটা বাইরের গাড়িবারান্দায় এসে পড়েছে। যন্ত্রচালিতের মতই দুজনে হলঘরটার মধ্যে খোলা দরজা-পথে গিয়ে প্রবেশ করল।
তাদের কাকা বিনয়েন্দ্রর আকস্মিক নিহত হবার সংবাদটা যেন দুজনেরই মনকে অতর্কিত আঘাতে একেবারে অবশ করে দিয়েছে। সত্যি কথা বটে দীর্ঘদিন ঐ কাকার সঙ্গে তাদের কোন সম্পর্কই ছিল না। এমন কি দীর্ঘ গত দশ বছরে পরস্পরের মধ্যে কোন পত্রযোগে সংবাদের আদান-প্রদান পর্যন্ত ছিল না।
তথাপি সংবাদটা তাদের বিহ্বল করে দিয়েছে। ব্যাপারটা সঠিক কি হল, এখনও যেন তারা বুঝে উঠতে পারছে না।
হলঘরের মধ্যে প্রবেশ করে তাই তারা দুজনেই যেন থমকে দাঁড়াল।
এ বাড়িতে ইতিপূর্বে ওরা কখনও আসেনি। এই প্রথম এল। বিরাট হলঘরটি। এক পাশে চৌকির উপরে বিস্তৃত ফরাস। তার উপর এদিক-ওদিক কয়েকটা মলিন তাকিয়া পড়ে আছে।