পুরন্দর চলে গেলেন সিঙ্গাপুরে। সেখানে গিয়ে লিং সিংয়ের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়লেন। পুরন্দর বর্ণিত সিঙ্গাপুর-কাহিনী প্রায় সবটাই সত্য কেবল সত্য নয় তাঁর স্ত্রী ও পুত্রের অকস্মিক সর্পদংশনে মৃত্যুর কথাটা। তাদের তিনি নিজ হাতে বিষ দিয়ে হত্যা করে সেই বাড়িতেই কবর দিয়েছিলেন। এবং পরে অবিশ্যি ওই সংবাদ তারযোগে সিঙ্গাপুর স্পেশাল পুলিসই মাত্র কয়েকদিন আগে আমাকে জানায়। সেই নৃশংস হত্যার পর থেকে পুরন্দর অন্য নামে আত্মগোপন করে বেড়াচ্ছিল এতকাল।
তাই বলছিলাম পুরন্দর চৌধুরী শুধু নৃশংসই নয়, মহাপাষণ্ড।
এদিকে বিনয়েন্দ্র অনাদি চক্রবর্তীর বিষয়-সম্পত্তি পেয়ে নতুন করে আবার জীবন শুরু করলেন। এবং ক্রমে পুরন্দর ও বিনয়েন্দ্রের পরস্পরের প্রতি পোষিত যে হিংসাটা দীর্ঘদিনের অদর্শনে বোধ হয় একটু ঝিমিয়ে এসেছিল, সেটা ঠিক সেই সময়েই অকস্মাৎ একদিন জ্বলে উঠল পুরন্দর কলকাতায় এসে বিনয়েন্দ্রর সঙ্গে দেখা করায় এবং সেখানে তাকে দেখে নতুন করে আবার সেটা জেগে উঠল দীর্ঘকাল পরে। যার ফলে যাবার পূর্বে পুরন্দর বিনয়েন্দ্রকে সিঙ্গাপুরী মুক্তার নেশায় হাতেখড়ি দিয়ে গেলেন।
সিঙ্গাপুরী মুক্তার নেশা ধরানোর ব্যাপারটা পূর্বাহেই অবিশ্যি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য পুরন্দর চৌধুরী মিঃ বসাকের নিকট তাঁর বিবৃতিকালে স্বীকার করেছিলেন।
ঐ সময় তার সঙ্গেও নিশ্চয়ই পুরন্দরের কোন কথাবার্তা হয়েছিল, যাতে করে ঐ সিঙ্গাপুরী মুক্তার নেশায় কবলিত করে তাকে দীর্ঘ দিন ধরে দোহন করে করে বিয়েকে একেবারে ঝাঁঝরা করে ফেলা ও লতাকে পাওয়া যায়। এক ঢিলে দুই পাখি বধ করা।
বলাই বাহুল্য, ইতিপূর্বে একসময় তার চাকরি গিয়ে বেকার হয়ে পড়ে। আর ঠিক সেই সময় দৈবক্রমেই যেন একজন ল্যাবটারী অ্যাসিস্টেস্টের প্রয়োজন হওয়ায় কাগজে বিজ্ঞাপন দেয় বিনয়েন্দ্র। সেই বিজ্ঞাপন দেখে লতা আবেদন পাঠায়। আবেদনকারীদের মধ্যে হঠাৎ লতার আবেদনপত্র দেখে প্রথমটায় বিনয়েন্দ্রর কি রকম সন্দেহ হয়। তিনি তাকে একটা চিঠি দেন দেখা করবার জন্য লতা পত্রের জবাব দেয়, এবারে আর লতাকে চিনতে বিনয়েন্দ্রর কষ্ট হয় না। আবার লতাকে তিনি চিঠি দেন সাক্ষাতের জন্য। লতা সাক্ষাৎ করতে এল এবং বলাই বাহুল্য দীর্ঘদিন পর লতার প্রতি যে সুপ্ত প্রেম এতকাল বিনয়েন্দ্রর অবচেতন মনে ধিকি ধিকি জ্বলছিল তা লেলিহ হয়ে উঠল দ্বিগুণ তেজে। লতা কাজে বহাল হল। লতা অবিশ্যি তখনও অবিবাহিতা।
লতাকে বিনয়েন্দ্ররনীলকুঠিতে অকস্মিকভাবে আবিষ্কার করবার পরই পুরন্দরেরমনেলতাকে ঘিরে আবার বাসনার আগুন দ্বিগুণভাবে জ্বলে ওঠে। তাছাড়া বেলাকে বিবাহ করলেও তার প্রতি কোনদিনই সত্যিকারের ভালবাসা জন্মায়নি তার। এবং লতাকে দ্বিতীয়বার আবিষ্কার করার সঙ্গে সঙ্গেই লতার প্রতি তার পুরাতন দিনের আকর্ষণ আবার নতুন করে জেগে উঠল। বেলাকে ও তার পুত্রকে হত্যা করে লতাকে বিবাহ করবার পথ পরিষ্কার করে নিয়েছিল পুরন্দর। বেলার মৃতদেহ কোনদিন দৈবক্রমে যদি আবিষ্কৃত হয় তখন যাতে সহজেই হত্যার দায় থেকে নিষ্কৃতি পেতে পারে, ঐ কাল্পনিক কাহিনী পূর্বাহেই বলবার অন্যতম আর একটি কারণ ছিল বোধ হয় তাই আমার কাছে।
পরে সিঙ্গাপুরে ফিরে গিয়ে বেলাকে হত্যা করে সেই যে পুরন্দর আবার কলকাতায় এল আর ফিরে গেল না সেখানে। নীলকুঠির পাশেই সেই ভাঙা বাড়িতে গোপন আশ্রয় নিল ও; প্রতি রাত্রে উভয়ের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ হতে লাগল এবং সেই সঙ্গে চলতে লাগল বিনয়েন্দ্রকে হত্যা করবার পরিকল্পনা। সেই ভাঙা বাড়িতে তাদের গতিবিধির উপর যাতে কারও নজর না পড়ে সেজন্য দ্বিতীয় আর একজনকে সেখানে নিয়ে আসা হল মিশিরজীর পরিচয়ে। অর্থাৎ এবারে পাকাপোক্তভাবেই শুরু হল ওদের অভিযান। শুধু যে পুরন্দর চৌধুরীই দুঃসাহসীই ছিল তাই নয়, লতাও ছিল। পাঞ্জাবী বাপের রক্ত ছিল তার শরীরে, তাই তার পক্ষে সে রাত্রে কার্ণিশ বেয়ে পুরন্দরের পিছু পিছু সুজাতার শয়নকক্ষে প্রবেশ করাটা এমন কষ্টসাধ্য হয়নি কিছু। সে যাক, যা বলছিলাম।
৪১.
সে যাক, যা বলছিলাম, প্রশান্ত বসাক বলতে লাগলেন। পূর্ব পরিকল্পনা মতই সব ঠিক হয়ে গেলে ড্রাইভার করালীকে ওখানে প্রহরায় রেখে লতা অকস্মাৎ একদিন অন্তৰ্হিতা হল। এবং নীলকুঠি থেকে অন্তৰ্হিতা হয়ে সে প্রবেশ করল গিয়ে ভাঙা বাড়িতে।
হত্যার দিন রাত্রে করালীর সাহায্যে সদর খুলিয়ে লতা এল বিনয়েন্দ্রর সঙ্গে দেখা করতে। সবে হয়তো তখন বিনয়েন্দ্র সিঙ্গাপুরী মুক্তার নেশায় রঙিন হয়ে উঠেছে। লতা এসেই দরজায় নক করে এবং বিনয়েন্দ্র অকস্মাৎ ঐ রাত্রে গবেষণা-ঘরের দরজা খুলে লতাকে সামনে দেখে বিহ্বল হয়ে যান। আনন্দিতও যে হয়েছিলেন সেটা বলাই বাহুল্য। এবং তারপর ঘরের দরজা খোলাই ছিল। পরে একসময় বিনয়েন্দ্রর অজ্ঞাতে পুরন্দর ল্যাবরেটারী ঘরে প্রবেশ করে। লতার সঙ্গে গল্পে মশগুল বিনয়েন্দ্র, এমন সময় পশ্চাৎদিক থেকে পুরন্দর এসে বিনয়েন্দ্রর ঘাড়ে আঘাত করে। বিনয়েন্দ্র অতর্কিত আঘাতে টুল থেকে পড়ে যান মাটিতে এবং পড়বার সময় তাঁর হাতে লেগে টেবিলের উপর থেকে ঘড়িটা ও দু-একটা কাঁচের যন্ত্রপাতিও সম্ভবত মেঝেতে পড়ে গিয়ে ভেঙে যায়। একটা কাঁচের পাত্রে খানিকটা অ্যাসিড ছিল, সেটা মেঝেতে পড়ে যায়। ঘাড়ে আঘাত করে বিয়েকে অজ্ঞান করে পুরন্দর বিচিত্র ওই স্পেয়িং অ্যাপারেটাসটার সাহায্যে বিনয়েন্দ্রর গলারমধ্যে আরো সর্পবিষ ঢেলে দেয়। তারপর ব্যাপারটাকে আত্মহত্যার রূপ দেবার জন্য মেঝের ভাঙা কাঁচের টুকরো ও অ্যাসিড সরিয়ে ও মুছে নিতে গিয়ে অতর্কিতে লতার পা কেটে যায়। তখন সে রক্ত ধুয়ে ফেলতে ও ঘরের মেঝের সব চিছু মুছে নিতে ঘরের ওয়াশিং সিঙ্কের ট্যাপ খুলে ন্যাকড়া বা রুমাল জলে ভিজিয়ে সব ধুয়ে মুছে ফেলে। কিন্তু মেঝে থেকে অ্যাসিডের দাগ একেবারে যায় না এবং চলে যাবার সময় পুরন্দর ট্যাপটা বন্ধ করে রেখে যেতে ভুলে যায়। কাঁচের ভাঙা টুকরোয় পা কেটে যাওয়ায় লতা বিনয়েন্দ্রর রবারের চপ্পল-জোড়া পায়ে দিয়ে নিয়েছিল, কারণ সে এসেছিল খালি পায়ে। যে চপ্পল আমি পাশের বাড়ির মধ্যে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। শুধুমাত্র বিনয়েন্দ্রর হত্যাব্যাপারটাকে আত্মহত্যার রূপই যে দেওয়ার প্রচেষ্টা হয়েছিল তা নয়, ঐ হত্যা প্রচেষ্টার পূর্বে সঙ্গে সঙ্গে একটা ভৌতিক ব্যাপারও গড়ে তোলা হয়েছিল। মধ্যে মধ্যে কিছুদিন হতেই করালীর প্রচেষ্টায়, বলাবাহুল্য আমার একটা কথা বলতে ভুল হয়ে গিয়েছে। বিনয়েন্দ্রর মৃতদেহের পাশে গ্লাস-বিকারের মধ্যে যে তরল পদার্থ পাওয়া গিয়েছিল তার মধ্যেও পরীক্ষা করে সর্প-বিষ পাওয়া যায়। তাতে করে অবিশ্যি বিনয়েন্দ্রের দেহে সর্প-বিষ পাওয়ার ব্যপারটা যে আদৌ আত্মহত্যা নয় এবং হত্যাই সেটা আমার আরও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস হয়। কারণ বিনয়েন্দ্র যে সর্প-বিষ নিয়ে গবেষণা করছিল তার কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাই তার বিকারে সর্প-বিষ পাওয়া ও মৃত্যুর কারণ সর্প-বিষ হওয়ার সন্দেহটা বৃদ্ধি করেছিল। এই গেল বিনয়েন্দ্রর হত্যার ব্যাপার! দ্বিতীয়, রামচরণকেও হত্যা করে পুরন্দর চৌধুরীই পররাত্রে। এবং হত্যা করবার পর সে ল্যাবরেটারীতে যায় নিজের একটা alibi তৈরী করবার জন্য। আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করবার জন্য। সে ভালভাবেই জানত যে রাত্রে আমি সজাগ থাকব ও সহজেই সে আমার দৃষ্টিতে পড়বে এবং তখন তার সেই কাহিনী বলে আমাকে সে তার ব্যাপারে সন্দেহ থেকে নিজেকে মুক্ত করে রাখবে পূর্বেই বলেছি সে-কথা। কিন্তু সে বুঝতে পারেনি যে কিরীটীর সঙ্গে আলোচনার পর তাঁর উপরেই আমার সন্দেহটা জাগতে পারে এবং আমি সেইভাবেই পরে তদন্ত চালাতে পারি। কিরীটীই পুরন্দরের উপরে আমার মনে প্রথমে সন্দেহ জাগ্রত করে ও চিঠিগুলোর উপরে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করায়। পরে অবিশ্যি আলাদা আলাদা কাগজে জবানবন্দি লিখে তার উপরে প্রত্যেকের নাম দস্তখত করতে আমি সকলকে বাধ্য করি। এবং প্রত্যেকের আলাদা হাতের লেখা ও তার সঙ্গে সুজাতা, রজত ও পুরন্দর চৌধুরীর কাছে প্রাপ্ত বিনয়েন্দ্রর নামে লেখা চিঠির লেখা মেলাতেই দেখা গেল, একমাত্র পুরন্দর চৌধুরীর হাতের লেখার সঙ্গেই বেশ যেন কিছুটা মিল আছে। পরে অবিশ্যি হাতের লেখার বিশেষজ্ঞও সেই মতই দিয়েছেন। যা হোক, তারপর পুরন্দর চৌধুরীর প্রতিই সন্দেহটা আরো যেন আমার ঘণীভূত হয়। এবং এখানে আর একটা কথা বলা প্রয়োজন, ঐ তিনখানা চিঠি যে আদৌ বিনয়েন্দ্রর লেখা নয় সেটার প্রমাণ পূর্বেই আমি পেয়েছিলাম বিনয়েন্দ্রর ল্যাবরেটারী ঘরের মধ্যে ড্রয়ারে প্রাপ্ত তার নোট-বইয়ের মধ্যেকার বাংলা লেখা দেখে এবং সেই লেখার সঙ্গে চিঠির লেখা মেলাতেই। বিনয়েন্দ্রকে হত্যা করা হয়েছিল। এবং তাঁর হত্যার সংবাদও তাঁর সম্পত্তির ওয়ারিশন হিসাবে রজত ও সুজাতা পেতই একদিন না একদিন। তবে তাদের ওভাবে অত তাড়াতাড়ি হত্যা-মঞ্চে টেনে আনা হল কেন বিনয়েন্দ্রর নামে চিঠি দিয়ে? তারও কারণ ছিল বৈকি। এবং সেটা বুঝতে হলে আমাদের আসতে হবে পুরন্দর চৌধুরীর সত্যিকারের পরিচয়ে। কে ওই পুরন্দর চৌধুরী।