কিন্তু কথা হচ্ছে ঐ ভাবে বিশেষ অ্যাপারেটাসের সাহায্যে দেহের মধ্যে বিষ প্রয়োগ না করে সাধারণভাবেও তো গলায় বিষ ঢেলে কাজ শেষ করা যেতে পারত। তার জবাবে আমার মনে হয়, অজ্ঞান অবস্থায় বিষ গলায় ঢেলে দিলেও যদি তার খুব বেশি অংশ পেটের মধ্যে না যায় তো কাজ হবে না, অথচ অজ্ঞান অবস্থায় খুব বেশি বিষও ভিতরে প্রবেশ করানো কষ্টসাধ্য হবে। এবং সম্ভবতঃ সেইটাই ছিল কারণ। দ্বিতীয় কারণ, এমন অভিনব একটা পথ নেওয়া হয়েছিল যাতে করে কারো মনে কোনরূপ সন্দেহই না জাগে। এখন কথা হচ্ছে, বিশেষ করে সর্প-বিষই কেন হত্যাকারী বেছে নিয়েছিল বিয়েকে হত্যা করবার যন্ত্রস্বরূপ? তার উত্তরে বলব, বিনয়েন্দ্র সর্প-বিষের নেশায় অভ্যস্ত ছিল। যাতে তার দেহে বিষ পেলেও পুরন্দরের কাহিনী শুনে লোকে মনে করত, হয় বিনয়েন্দ্র আত্মহত্যা করেছে না হয় বেশি খেয়ে সর্প-বিষে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে। আর যে বিষে সে অভ্যস্ত ছিল সে বিষ দিয়ে হত্যা করতে হয়েছিল বলেই বেশি পরিমাণ বিষের প্রয়োজন হয়েছিল।
কিন্তু যা বলছিলাম, পুরন্দর চৌধুরী ও লতা দুই বিজ্ঞানীর মিলিত হত্যা-প্রচেষ্টা অভিনব সন্দেহ নেই। কিন্তু আমাদের সকলের দৃষ্টির বাইরে ত্রিকালদশী একজন, যিনি সর্বদা দুটি চক্ষু মেলে সদা জাগ্রত, সদা সচেতন, যাঁর বিচার ও দণ্ড বড় সূক্ষ, তাঁকে যে আজ পর্যন্ত কেউ এড়াতে পারেনিদগবী মানুষ তা ভুলে যায়। আজ পর্যন্ত কোন পাপ, কোন দুষ্কৃতিই যে চিরদিনের জন্য ঢাকা থাকে না আমরা তা বুঝতে চাই না বলেই না পদে পদে আমরা পর্যদুস্ত, লাঞ্ছিত, অপমানিত হই।
.
৩৮.
পুরন্দর চৌধুরী, লতা ও করালীকে রামানন্দ সেনই পুলিস-ভ্যানে করে নিয়ে গেলেন যাবার সময়।
অভিশপ্ত নীলকুঠি!
সন্ধ্যার দিকে ঐ নীলকুঠির ঘরে ঘরে ও সদর দরজায় তালা পড়ে গেল।
রজত কলকাতায় চলে গেল।
আর সুজাতা গেল তার দূর সম্পর্কীয় এক মাসীর বাড়িতে বরাহনগর। ছুটির এখনো দশটা দিন বাকি আছে, সুজাতা সে দশটা দিন মাসীর ওখানেই থাকবে স্থির করল।
দিন পাঁচেক বাদে বিকেলের দিকে প্রশান্ত বসাক কী একটা কাজে দক্ষিণেশ্বর গিয়েছিলেন, ফেরবার পথে কি মনে করে সুজাতার মাসীর বাড়ির দরজায় এসে গাড়িটা থামালেন।
সুজাতা বাসাতেই ছিল, সংবাদ পেয়ে বাইরে এল।
আপনি!
হ্যাঁ, হঠাৎ এদিকে একটা কাজে এসেছিলাম, তাই ভাবলাম যাবার পথে আপনার সঙ্গে দেখা করে যাই।
বসুন। দাঁড়িয়ে রইলেন কেন? সুজাতা বলে।
খালি একটা চেয়ারে বসতে বসতে প্রশান্ত বসাক বললেন, লক্ষ্ণৌ ফিরে যাচ্ছেন কবে?
আরও দিন দশেকের ছুটি নিয়েছি।
তাহলে এখন এখানেই থাকবেন বলুন?
তাই তো ভাবছি।
এবং শুধু ঐ দিনই নয় তার পরের সপ্তাহে আরও চার-পাঁচবার দুজনে দেখা হল।
হঠাৎ তার পর থেকে ঘন ঘন কাজ পড়ে যায় যেন ঐ দিকে প্রশান্ত বসাকের এবং ফেরবার পথেই দেখাটা করেন তিনি সুজাতার সঙ্গে। কারণ সুজাতার কথা তাঁর মনে পড়ে প্রত্যেকবারেই।
অবশ্য সেটা খুবই স্বাভাবিক।
সেদিন দ্বিপ্রহরে রামানন্দ সেনের সঙ্গে হেডকোয়ার্টারের নিজস্ব অফিসরুমে বসে প্রশান্ত বসাক নীলকুঠির হত্যাব্যাপার নিয়েই আবার আলোচনা করছিলেন।
পুরন্দর চৌধুরী বা লতা এখনও তাদের কোন জবানবন্দি দেয়নি।
তদন্ত চলছে, পুরোপুরি সেটাও এখনও তৈরী করা যায়নি।
রামানন্দ সেন বলছিলেন, কিন্তু আপনি ওদের সন্দেহ করলেন কি করে ইন্সপেক্টার?
ব্যাপারটা যে আত্মহত্যা নয়, হত্যা-নিষ্ঠুর হত্যা, সে আমি অকুস্থানে অর্থাৎ ল্যাবরেটারী ঘরে প্রবেশ করে, মৃতদেহটা পরীক্ষা করে ও অন্যান্য সব কিছু দেখেই বুঝেছিলাম মিঃ সেন, আর তাতেই সন্দেহটা আমার ওদের উপরে ঘনীভূত হয়।
কি রকম?
প্রথমতঃ মৃতদেহের position, সে সম্পর্কে পূর্বেই আমি আলোচনা করেছি আপনাদের সঙ্গে। দ্বিতীয়তঃ, মৃতদেহ ও তার ময়নাতদন্তের রিপোের্টও তাই প্রমাণ করেছে। তৃতীয়তঃ, বিনয়েন্দ্রর নিত্যব্যবহার্য অপহৃত রবারের চপ্পলজোড়া। সেটা কোথায় গেল? আপনাদের বলিনি সেটা রক্তমাখা অবস্থায় পাওয়া যায় নীলকুঠির বাঁ পাশের পোড়ো বাড়ির মধ্যে। খুব সম্ভব অতর্কিতে ঘাড়ে আঘাত পেয়ে বিনয়েন্দ্র যখন মেঝেতে পড়ে যান তখন টেবিলের উপর থেকে ঘড়িটার সঙ্গে সঙ্গে কিছু কাঁচের অ্যাপারেটাও মেঝেতে পড়ে গিয়ে ভেঙে যায়; যে ভাঙা কাঁচের টুকরোয় হত্যাকারী বা তার সঙ্গীর সম্ভবত পা কেটে যায়। রক্ত পড়তে থাকে। তখন তারা ঘরের সিঙ্কের ট্যাপে পা ঘোয় ও পরে ঐ চপ্পলজোড়া পায়ে দিয়েই হয়তো ঘর থেকে বের হয়ে যায় যাতে করে রক্তমাখা পায়ের ছাপ মেঝেতে না পড়ে। আপনি জানেন না মিঃ সেন, ওদের যেদিন অ্যারেস্ট করা হয় সেই দিনই হাজতে পুরন্দর চৌধুরী ও লতার পা পরীক্ষা করে দেখা যায় লতাদেবীর পায়েই ব্যাণ্ডেজ বাঁধা ছিল। এবং তারই পায়ের পাতায় ক্ষত ছিল। পা খোবার পর উত্তেজনার মধ্যে ওরা ঘরের সিঙ্কের ট্যাপটা বন্ধ করে রেখে যেতে ভুলে যায়—যেটা খুব স্বাভাবিক, আর তাইতেই সেই ট্যাপটা আমরা খোলা অবস্থায় দেখি। নীলকুঠিতে ওদের প্রবেশে অত রাত্রে সাহায্য করেছিল করালী, এবং ওরা দুজনে যখন করালীর সাহায্যে নীলকুঠিতে প্রবেশকরে বা বের হয়ে যায় তখন হয়তো রামচরণের নজরে ওরা পড়েছিল বলেই তাকে প্রাণ দিতে হল পরে হত্যাকারীর হাতে। দ্বিতীয় রাত্রে আমার সঙ্গে যখন ল্যাবরেটারী ঘরের মধ্যে বসে এক কাল্পনিক কাহিনী বলে নিজেকে সন্দেহমুক্ত করবার জন্য ও নিজের alibi সৃষ্টির চেষ্টায় আমাকে বোকা বোঝাবার চেষ্টায় রত ছিল, সম্ভবতঃপূর্বেই পুরন্দর রামচরণকে হত্যা করে কাজ শেষ করে এসেছিল। এবং কেমন করে সে রাত্রে সেটা সম্ভব হয়েছিল নীলকুঠির উপরের ও নীচের তলাকার নকশা দেখলেই আপনি তা বুঝতে পারবেন। রাত্রে সকলের শয়নের কিছুক্ষণ পরেই পুরন্দর চৌধুরী ঘর থেকে বের হয়ে যান এবং বারান্দা পার হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে যান। করালীর সাহায্যে রামচরণকে হত্যা করে দোতলায় ওঠবার ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে আসে আবার। তারপর আমার দৃষ্টি তার প্রতি আকর্ষণ করবার জন্য শব্দ করে ল্যাবরেটারী ঘরের দিকে যায়। কারণ সে জানত আমি সম্ভবত জেগেই থাকব। এবং পূর্বেও ছায়াকুহেলীর দুঃস্বপ্ন গড়ে তোলবার জন্য। ঐ সিঁড়ি দিয়েই সে উপরে উঠে যেত; কারণ অন্য সিঁড়ির দরজাটা রাত্রে বন্ধ থাকত। শেষ, রাত্রে যেদিন করালীকে দেখে সুজাতাদেবী ভয় পেয়েছিলেন সে রাত্রেও ওই ঘোরানো সিঁড়ি দিয়েই উপরে উঠে পালাবার সময়ও সেই পথেই পালায়। এবারে আসা যাক ওদের আমি। সন্দেহ করলাম কি করে। পুরন্দর চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রথম প্রমাণ, সেই চিঠি। যা বিনয়েন্দ্রর নামে রজতবাবু ও সুজাতাদেবীকে ও তার নামেও লেখা হয়েছিল। চিঠিটা যে পুরন্দরেরই নিজের হাতে লেখা সেটা তার কৌশলে জবানবন্দির কাগজে নাম দস্তখত করে নেওয়ার ছলে সংগ্রহ করে দুটো লেখা মিলিয়ে দেখতেই ধরা পড়ে যায় আমার কাছে। কিন্তু কথা। হচ্ছে, ওভাবে risk সে নিতে গেল কেন? বোধ হয় তার মধ্যেও ছিল তার আত্ম-অহমিকা বা সুনিশ্চিয়তা নিজরে উপরে। দ্বিতীয় প্রমাণ, পুরন্দর চৌধুরীর জবানবন্দি, যা আমার মনে সন্দেহের সৃষ্টি করে। খবর নিয়ে আমি জেনেছিলাম, গত পনেরদিন ধরেই পুরন্দর চৌধুরী কলকাতার এক হোটেলে ছিল। হোটেলটির নাম হোটেল স্যাভয়। সেখানকার এক বয়ের মুখেই সংবাদটা আমি পাই। তৃতীয় প্রমাণ, লতাকে আমার লোক অনুসরণ করে জানতে পারে সেও হোটেল স্যাভয়ে উঠেছিল পুরন্দরের সঙ্গে পুরুষের বেশে, কিন্তু সে যে পুরুষ নয় নারী, সেও এ হোটেলের বয়ই অতর্কিতে একদিন জানতে পারে। তারপরে বাকিটা আমি অনুমান করে নিয়েছিলাম ও কিরীটী আমার দৃষ্টিকে সজাগ করে দিয়েছিল।