প্রশান্ত বসাক এবারে বললেন, হ্যাঁ, যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই। দেখলেন তে। এখন বোধ হয় বুঝতে পারছেন এই বিশেষ যন্ত্রটির সাহায্যেই হতভাগ্য বিনয়েন্দ্রবাবুকে সেই রাত্রে এবং পরশু রাত্রে হতভাগ্য রামচরণকে হত্যা করা হয়।
উঃ, কি সাংঘাতিক! রামানন্দ সেন বলেন আত্মগতভাবে।
হ্যাঁ, সাংঘাতিকই বটে। এবং অবিশ্বাস্য ব্যাপারও বটে। প্রশান্ত বসাক আবার বললেন। তারপর একটু থেমে আবার শুরু করলেন, যে বিজ্ঞান মানুষের সমাজজীবনে এনেছে প্রভূত কল্যাণ, যে বিজ্ঞানবুদ্ধি ও আবিষ্কার যুগে যুগে সমাজ-জীবনের পথকে নব নব সাফল্যের দিকে এগিয়ে দিয়েছে, সেই বিজ্ঞান-প্রতিভাই বিকৃত পথ ধরেই এনেছে অমঙ্গল—সর্বনাশা ধ্বংস। লতাদেবী ও মিঃ চৌধুরী দুজনেই অপূর্ব বৈজ্ঞানিক প্রতিভা নিয়ে এসেছিলেন, কিন্তু বিকৃত বুদ্ধিতে আচ্ছন্ন হয়ে ওঁদের উভয়ের মিলিত প্রতিভা মঙ্গল ও সুন্দরের পথকে খুঁজে পেলেন না। ফলে ওঁরা নিজেরাও ব্যর্থ হলেন, ওঁদের প্রতিভাও ব্যর্থ হল।
.
ওদিকে রাত প্রায় ভোর হয়ে এসেছিল।
ঘরের জানলাপথে প্রথম আলোর আবছা আভাস এসে উঁকি দেয়।
লতা ও পুরন্দর চৌধুরীকে আপাততঃ আলাদা আলাদা করে দুজনকেই পুলিসের হেপাজতে রেখে সকলে নীচের ঘরে নেমে এলেন।
সংবাদ পেয়ে রজতও এসে ওঁদের সঙ্গে যোগ দিল।
প্রশান্ত বসাকের নির্দেশমত ড্রাইভার করালীকেও পূর্বাহ্নেই অ্যারেস্ট করা হয়েছিল।
সুজাতা, রজত ও রামানন্দ সেন সকলেই উদগ্রীব সমগ্র রহস্যটা জানবার জন্য। কী ভাবে বিনয়েন্দ্র ও রামচরণ নিহত হল, আর কেনই বা হল।
মিঃ বসাক বলতে লাগলেন তখন সেই কাহিনী।
.
৩৭.
কিরীটী আমাকে সব শুনে বলেছিল এই হত্যা-রহস্যের মধ্যে কোন একটি নারী আছে। কিরীটীর কথা শুনে সমগ্র ঘটনা পুনর্বার আমি আদ্যপান্ত মনে মনে বিশ্লেষণ করি। এবং তখনই আমার মনে পড়ে বিনয়েন্দ্র নিহত হবার কিছুদিন পুর্বেই এই নীলকুঠিতে এক রহস্যময়ী নারীর আবির্ভাব ঘটেছিল। এবং যে নারী অকস্মাৎ যেমন এখানে এসে একদিন উদয় হয়েছিল তেমনি অকস্মাৎ আবার একদিন দৃষ্টির অন্তরালে আত্মগোপন পরে। রামচরণের মুখেই আমি জানতে পারি যে, তার নাম লতা। বলাই বাহুল্য, আমার মন তখন সেই অন্তরালবর্তিনী লতার প্রতিই আকৃষ্ট হয়। এখন অবিশি স্পষ্টই বুঝতে পারছি, সুন্দরলালের ছদ্মবেশের অন্তরালেই ছিল সেই লতা এবং সেই সঙ্গে এও বুঝতে পারছি, ওই লতা বিনয়েন্দ্র ও পুরন্দর চৌধুরী উভয়েরই যথেষ্ট পরিচিত ছিল; যেহেতু প্রথমতঃ ল্যাবরেটারী অ্যাসিস্টেন্টরূপে সমস্ত প্রার্থীর মধ্যে লতাকেই যখন বিনয়েন্দ্র মনোনীত করেছিলেন তখন তার প্রতি তাঁর পক্ষপাতিত্ব প্রমাণ হয়েছে ও সেই সঙ্গে প্রমাণ হয়েছে লতা তাঁর মনের অনেকখানিই অধিকার করেছিল। তার আরো প্রমাণলতানামটি আমি বিনয়েন্দ্ররনোটবুকেরবহু পাতাতেই পেয়েছি। এখন কথা হচ্ছে লতা বিনয়েন্দ্র ও পুরন্দর চৌধুরী এই ট্রায়োর পরিচয় পরস্পরের সঙ্গে কতদিন ধরে। গোলমালটা অবিশ্যি গড়ে উঠেছে দুটি পুরুষ বন্ধুর মধ্যে এ মধ্যবর্তিনী নারীকেই কেন্দ্র করে। কিন্তু হত্যার কারণটা কি একমাত্র তাই, না আরো কিছু? এই তথ্যটি অবিশ্যি এখন আমাকে আবিষ্কার করতে হবে। তবে বিনয়েন্দ্র রামচরণকে হত্যা করা হয়েছিল কি ভাবে সেটা এখন আমি স্পষ্টই অনুমান করতে পারছি। এবং সে অনুমানের পরেই আমার মনে হচ্ছে সে রাত্রে যখন বিয়ে তাঁর গবেষণাগারে নিজের কাজে ব্যস্ত তখন হয়তো লতা এসে দরজায় টোকা দেয়। দরজা খুলে লতাকে দেখতে পেয়ে অত রাত্রে নিশ্চয়ই প্রথমটায় বিনয়েন্দ্র বিস্মিত হন। এবং খুব সম্ভব লতার সঙ্গে যখন বিনয়েন্দ্র কথা বলছেন সেই সময় তাঁর অলক্ষ্যে এক ফাঁকে ঘরে প্রবেশ করে পশ্চাৎ দিক হতে এসে অতর্কিতে কোন কিছু ভারী বস্তুর সাহায্যে পুরন্দর চৌধুরী বিনয়েন্দ্রকে তাঁর ঘাড়ে আঘাত করেন। যার ফলে বিনয়েন্দ্র পড়ে যান ও পড়ে যাবার সময় ধাক্কা লেগে বা কোন কারণে টেবিল থেকে আরও দু-একটা কাঁচের যন্ত্রপাতির সঙ্গে বোধ হয় ঘড়িটা মাটিতে ছিটকে পড়ে ভেঙে যায়। কিন্তু এর মধ্যেও কথা আছে, ঐ ভাবে মাথায় বা ঘাড়ে অতর্কিতে একটা আঘাত হেনেইতো হতঅগ্য বিনয়েন্দ্রকে হত্যা করা যেত। তবে কেন আবার ভয়ঙ্কর মৃত্যুগরল সর্পবিষ প্রয়োগ করা হল তার শরীরে? আর একাকী পুরন্দর চৌধুরীই তো তার বন্ধুকে হত্যা করতে পারত; তবে লতার সহযোগিতার প্রয়োজন হল কেন? মনে হয় আমার, প্রথমতঃ তার কারণ ব্যাপারটাকে আত্মহত্যার রূপ দেবার জন্যই ঐ ভাবে পিছন থেকে অতর্কিতে বিনয়েন্দ্রকে আঘাত হেনে প্রথমে কাবু করা হয়েছিল এবং এমন ভাবে সেই ভারী বস্তুটি কাপড় মুড়ে নেওয়া হয়েছিল যাতে করে সেই ভারী বস্তুটির আঘাতটা তার কাজ করবে, কিন্তু চিহ্ন রাখবে না দেহে। দ্বিতীয়তঃ, আঘাত হেনে অজ্ঞান করে দিতে পারলে পরে বিষ প্রয়োগকরবার সুবিধা হবে। এবং লতারসহযোগিতার প্রয়োজনও হয়েছিল; আমার মনে হয়, এই জন্যই অন্যথায় এত রাত্রে বিনয়েন্দ্রর গবেষণা-ঘরে পুরন্দর চৌধুরীর প্রবেশ সম্ভবপর ছিল না একা একা। এবং কোনমতে পুরন্দর চৌধুরী একা প্রবেশ করলেও হঠাৎ অমন করে পশ্চাৎ দিক থেকে আঘাত করবার সুযোগও পেত না, যেটা সহজ হয়ে গিয়েছিল উভয়ের মিলিত প্রচেষ্টায় ও সহযোগিতায়। এবং লতাকে প্রথমে ঘরে প্রবেশ করিয়ে দিয়ে তার সঙ্গে বিনয়েন্দ্রকে কথাবার্তার মধ্যে অন্যমনস্ক রেখে সেই ফাঁকে একসময় পশ্চাৎ দিক হতে গিয়ে পরম নিশ্চিন্তে বিনয়েন্দ্রকে আঘাত করা পুরন্দর চৌধুরীর পক্ষে ঢের বেশী সহজসাধ্য ছিল। যা হোক, আমার অনুমান ঐ ভাবেই বিয়েকে অজ্ঞান করে পরে সাক্ষাৎ মারণ-অস্ত্র ঐ বিশেষ অ্যাপারেটাটির সাহায্যেই মুখের মধ্যে সর্প-বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করা হয়। ঐ বস্তুটি জোর করে মুখে প্রবেশ করাবার চিহ্নও ছিল ওষ্ঠে, যা থেকে মৃতদেহ পরীক্ষা করেই মনে আমার সন্দেহ জাগায়। এবং পরে সমগ্র ব্যাপারটাকে হত্যা নয়, আত্মহত্যা এই রূপ দিয়ে হত্যাকারী আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করে। তারপর পরে মৃতদেহের পাশে একটা বিকারে কিছু সৰ্প-বিষ রেখে দেয় আত্মহত্যার প্রমাণস্বরূপ।