কিন্তু যত নিঃশব্দেই দ্বিতীয় ছায়ামূর্তি ঘরে প্রবেশ করুক না কেন, প্রথম ছায়ামূর্তি বোধ। হয় সেই ক্ষীণতম শব্দটুকুও শুনতে পেয়েছিল।
চকিতে প্রথম ছায়ামূর্তিও ঘুরে দাঁড়াল।
প্রথম ছায়ামূৰ্তি ঘুরে দাঁড়াবার আগেই দ্বিতীয় ছায়মূর্তি হাত বাড়িয়ে দেওয়ালের গায়ে আলোর সুইচটা টিপে দিয়েছিল। খুট করে একটা শব্দ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘরের বৈদ্যুতিক আলোটা জ্বলে ওঠে।
হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে সমস্ত কক্ষটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
ঠিক সেই মুহূর্তে বাথরুমের দরজাটা খুলে ঘরের মধ্যে পা দিয়েই বজ্রকঠিন কণ্ঠে মিঃ বসাক বলে উঠলেন, মিঃ চৌধুরী!
ঘরের মধ্যে যেন অকস্মাৎ বজ্রপাত হল।
বিদ্যুৎ-চমকের মতই যুগপৎ দুই ছায়ামূর্তিই ঘুরে দাঁড়ায়।
কৌতূহলী সুজাতাও ইতিমধ্যে প্রায় মিঃ বসাকের সঙ্গে সঙ্গেই ঘরের মধ্যে প্রবেশ করেছিল। সে দেখল মিঃ বসাকের উদ্যত পিস্তলের সামনে সামান্য দূরের ব্যবধানে ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে পুরন্দর চৌধুরী ও সুন্দরলাল। উভয়ের চোখেই হতভম্ব বোবা দৃষ্টি।
উদ্যত পিস্তল হাতে ওঁদের প্রতি দৃষ্টি রেখেই সুজাতাকে সম্বোধন করে মিঃ বসাক বললেন, সুজাতাদেবী, নীচে রামানন্দবাবু অপেক্ষা করছেন, তাঁকে ডেকে আনুন।
৩৬-৪২. থানা-ইনচার্জ রামানন্দ সেন
থানা-ইনচার্জ রামানন্দ সেন ঘরে এসে প্রবেশ করতেই মিঃ বসাক তাঁকে সম্বোধন করে বললেন, এঁদের গ্রেপ্তারের ব্যবস্থা করুন মিঃ সেন, এঁরাই বিনয়েন্দ্র রায় ও রামচরণের যুগ্ম হত্যাকারী।
রামানন্দ সেন বারেকের জন্য তাঁর সম্মুখে তখনো প্রস্তরমূর্তিবং দণ্ডায়মান পুরন্দর চৌধুরী ও সুন্দরলালের দিকে তাকিয়ে বললেন, এঁদের মধ্যে একজনকে তো চিনতে পারছি মিঃ বসাক কিন্তু দ্বিতীয় ব্যক্তিটিকে তো ঠিক এখনও চিনতে পারছি না। দ্বিতীয় ঐ মহাশয় ব্যক্তিটি কে?
মৃদু হাসলেন মিঃ বসাক রামানন্দ সেনের কথায়। তারপর স্মিতকৌতুকভরা কণ্ঠে বললেন, ভদ্রমহাশয় ব্যক্তি অর্থাৎ পুরুষ উনি নন, উনি ভদ্রমহিলা,মিঃ সেন।
পুরুষ নন, মহিলা! বিস্মিত কণ্ঠ হতে উচ্চারিত হয় কথাটা রামানন্দ সেনের। এবং শুধু রামানন্দ সেনই নন। ঘরের মধ্যে ঐ সময় উপস্থিত সুজাতা মিঃ বসাকের কথায় কম বিস্মিত হয় না।
সে বলে ওঠে, কি বলছেন প্রশান্তবাবু!
ঠিকই বলেছি আমি মিস রয়। ওষ্ঠের উপরে চিকন ঐ গোঁফটি আসল নয়, মেকী, মাথার শিরস্ত্রাণ ঐ রেশমী পাগড়ি ওটিও আংশিক ছদ্মবেশ মাত্র। ওর নীচে রয়েছে বেণীবদ্ধ কেশ। চশমার কালো কাঁচের অন্তরালে রয়েছে নারীর দুটি চক্ষু।
কথাগুলো বলতে বলতেই ঘুরে দাঁড়ালেন মিঃ বসাক সুন্দরলালের দিকে এবং বললেন, উনি শ্রীমতী লতাদেবী।
আবার রামানন্দ সেন ও সুজাতা দুজনেই যুগপৎ চমকে মিঃ বসাকের দিকে তাকান।
কী বললেন? লতাদেবী!
কিন্তু যাকে সম্বোধন করে কথাগুলো মিঃ বসাক ক্ষণপূর্বে বললেন তিনি কিন্তু নির্বাক। পাষাণপুত্তলিকাবৎ নিশ্চল।
মিঃ বসাক পুনরায় বলে উঠলেন, এত তাড়াতাড়ি অবিশ্যি প্রথম দিনের দর্শনেই আপনার চেহারায়, কণ্ঠস্বরে ও হাতের আঙুলে আমার সন্দেহ হলেও আপনি যে সত্যি সত্যিই পুরুষ নন নারী এই স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারতাম না। যদি না আজই দ্বিপ্রহরের কিরীটীর সংকেত আপনার প্রতি আমাকে বিশেষভাবেই সজাগ করে দিত। তা সত্ত্বেও আমি বলব মিস সিং, আপনার ছদ্মবেশধারণ অপূর্ব নিখুঁত হয়েছিল।
একেবারে সামনাসামনি ও খোলাখুলিভাবে চ্যালেঞ্জড্ হলেও ছদ্মবেশী লতাদেবী পাষাণপুত্তলিকার মতই এতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু অকস্মাৎ যেন পরমুহূর্তেই পাথরের মত দণ্ডায়মান লতাদেবীকে তাঁর প্যান্টের পকেটে ডান হাতটা প্রবেশ করতে উদ্যত দেখেই চকিতে পিস্তল সমেত নিজের হাতটা উদ্যত করে মিঃ বসাক কঠিন কঠে বলে উঠলেন, No–No-সে চান্স আপনাকে আমি দেব না মিস সিং, প্যান্টের পকেট থেকে হাত সরান। সরান—Yes-হ্যাঁ, এতদিন ধরে এমন নৃশংস খেলা খেললেন, তারপরেও শেষটায় আপনারাই জিতে আমাদের মাত করে দিয়ে যাবেন, তাই কি হয়! বলতে বলতে মিঃ রামানন্দ সেনের দিকে তাকিয়ে মিঃ বসাক এবারে বললেন, মিঃ সেন, শ্রীমতী সিংয়ের বডিটা সার্চ করুন। চৌধুরী সাহেবকেও বাদ দেবেন না যেন।
দ্বিধামাত্র না করে রামানন্দ সেন ইন্সপেক্টারের নির্দেশমত এগিয়ে গেলেন, এবং লতা সিংয়ের বডি সার্চ করতেই তাঁর প্যান্টের পকেট থেকে বের হয়ে এল একটি মোটা কলমের মত বস্তু এবং শুধু তাই নয়, ছোট অটোমেটিক পিস্তলও একটি পাওয়া গেল।
আর পুরন্দর চৌধুরীর বডি সার্চ করে পাওয়া গেল একটি চমৎকারভাবে কাপড়ে মোড়া এক হাত পরিমাণ কালো প্লাস্টিকের তৈরী রড ও একটি অটোমেটিক পিস্তল।
প্লাস্টিকের রডটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে দেখছিলেন রামানন্দ। হঠাৎ সেদিকে নজর পড়ায় মিঃ বসাক বলে উঠলেন, সাবধান মিঃ সেন, ওটা যা ভাবছেন বোধ হয় তা নয়, নিছক একটি প্লাস্টিকের তৈরী রড নয়। আর আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে তো খুব সম্ভবত ওটা একটা প্ৰেয়িং অ্যাপারেটা। এবং ওর ভিতরে আছে তীব্র কালকূট,মেক ভেন।
কী বলছেন আপনি মিঃ বসাক!
ঠিকই বলছি বোধ হয়। দিন তো বস্তুটি আমার হাতে।
এগিয়ে দিলেন রামানন্দ সেন বস্তুটি ইন্সপেক্টারের হাতে। বসাক প্লাস্টিকের রডটি একটু পরীক্ষা করতেই দেখতে পেলেন, তার একদিকে রয়েছে কলমের ক্যাপের মত একটি ক্যাপ। এবং সেই ক্যাপটি খুলতেই দেখা গেল তার মাথার দিকটা যেমন সরু হয়ে আসে তেমনি তারও মাথার দিকটা ক্রমশ সরু হয়ে এসেছে। এবং সেই সরু অগ্রভাগে বিন্দু পরিমাণ একটি ছিদ্র। আরও ভাল করে পরীক্ষা করতে দেখা গেল রডটির অন্যদিকে একটি ক্ষুদ্র স্প্রিংও আছে। সেই স্পিংটা টিপতেই পিচকারীর মত কি খানিকটা গাঢ় তরল পদার্থ ছিটকে বের হয়ে এল।