কেন?
একজন সম্ভবত আসবেন, তাঁকে রিসিভ করতে হবে।
এত রাত্রে আবার কে আসবেন।
কে আসবেন তা জানি না, তবে আশা করছি একজনকে। অবিশ্যি ভাবছি হয়তো নাও আসতে পারেন আজ।
তবে মিথ্যে মিথ্যে জেগে থাকবেন কেন? আসবার যখন তাঁর কোন স্থিরতা নেই।
তাই তো জেগে থাকতে হবে। মহৎ ব্যক্তিবিশেষ আসছেন, অভ্যর্থনার জন্য না জেগে বসে থাকলে চলবেই বা কেন!
তা রেবতী বা দারোয়ানকে বলে রাখলেই তো পারতেন, তিনি এলে তখন আপনাকে খবর দিত।
মৃদু হাসির সঙ্গে প্রশান্ত বসাক বলেন, সোজা রাস্তা দিয়ে জনান্তিকে তিনি আসবেন না বলেই তো এত হাঙ্গামা।
কি আপনি বলছেন!
ঠিক তাই সুজাতাদেবী। তাইতো আপনাকে পূর্বাহ্নেই এ ঘরে এসেশোবার জন্য বলেছিলাম।
কিন্তু আমার সঙ্গে তাঁর আসবার কি সম্পর্ক?
সেইজন্যই তো এত সাবধানতা, এত সব আয়োজন। বিশেষ করে আপনি জানেন না, কিন্তু তিনি আপনারই জন্য আসবেন আমার ধারণা।
এ সব কি আপনি বলছেন বলুন তো প্রশান্তবাবু?
ভাবছেন হয়তো এই মাঝরাতে আপনাকে এ ঘরে ডেকে এনে আরব্য উপন্যাস শোনাতে শুরু করলাম, তাই না সুজাতাদেবী? বলতে বলতে আচমকা যেন কথার মোড় ঘুরিয়ে দিয়ে বললেন, কিন্তু আর না, এবারে আপনি শুয়ে ঘুমোবার চেষ্টা করুন, আমাকে একটু বাইরে যেতে হবে—
বাইরে এত রাত্রে।
হ্যাঁ, বেশী দূরে নয়, আপনার আজ রাত্রের পরিত্যক্ত শূন্য ঘরে। নিন, আপনি শুয়ে পড়ুন তো।
আমি আপনার সঙ্গে যাব।
কোথায়?
কেন, আমার ঘরে। এখন বুঝতে পারছি, আমার ঘরে আজ রাত্রে কিছু ঘটবে। আপনি জানেন, আর সেইজন্যই আমার বিছানার ওপরে পাশবালিশটা চাদর দিয়ে ঢেকে রেখে আমাকে এ ঘরে চলে আসতে বলেছিলেন।
হ্যাঁ, তাই সুজাতাদেবী। কিন্তু আপনি—আপনি জানেন না বা বুঝতে পারছেন না হয়তো সেখানে যাওয়া আপনার এখন খুব বিপজ্জনক, risky!
তা হোক, তবু আপনার সঙ্গে আমি যাব।
কিন্তু সুজাতাদেবী—
বললাম তো। যাব। সুজাতার কণ্ঠস্বরে একটা অদ্ভুত দৃঢ়তা।
কিন্তু আপনি! আপনি আমার সঙ্গে না গেলেই হয়তো ভাল করতেন সুজাতাদেবী।
ভাল-মন্দ বুঝি না। আমি যাব।
কয়েক মুহূর্ত প্রশান্ত বসাক কি যেন ভাবলেন, তারপর মৃদু নিস্পৃহ কণ্ঠে বললেন, বেশ, তবে চলুন।
প্রথমে প্রশান্ত বসাক দরজা খুলে বাইরের অন্ধকার বারান্দায় একবার উঁকি দিয়ে দেখে নিলেন বারান্দার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত, শূন্য খাঁ খাঁ করছে।
পা টিপে টিপে প্রথমে প্রশান্ত বসাক তারপর বের হলেন ঘর থেকে এবং তাঁর পশ্চাতে অনুসরণ করল তাঁকে সুজাতা। এদিকে ওদিকে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকাতে তাকাতে দুজনে সুজাতার ঘরের দিকে এগিয়ে চললেন।
ঘরের দরজাটা সুজাতা খুলেই রেখে এসেছিলেন। কেবলমাত্র দরজার কবাট দুটো ভেজানো ছিল প্রশান্ত বসাকের পূর্ব-নির্দেশ মত।
ভেজানো দরজার গায়ে কান পেতে কি যেন শোনবার চেষ্টা করলেন মিঃ বসাক; তারপর ধীরে ধীরে নিঃশব্দে ভেজানো কবাট দুটি ফাঁক করে প্রথমে ঘরের মধ্যে নিজে প্রবেশ করলেন এবং তাঁর পশ্চাতে প্রবেশ করে সুজাতা। তারপর দরজাটা বন্ধ করে দিলেন।
প্রথমটায় অন্ধকারে কিছুই বোঝা যায় না। ক্রমে একটু একটু করে ঘরের অন্ধকারটা যেন উভয়ের চোখেই সয়ে আসে।
বাগানের দিককার খোলা জানলা বরাবর খাটের উপরে বিস্তৃত শয্যায় অস্পষ্ট মনে হয় কে যেন চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে।
গায়ে হাত দিয়ে স্পর্শের ইঙ্গিতে মিঃ বসাক সুজাতাকে নিয়ে গিয়ে ঘরের সংলগ্ন যে বাথরুম তার মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করলেন।
চাপা সতর্ক কণ্ঠে সুজাতা প্রশ্ন করে, বাথরুমের মধ্যে এলেন কেন?
চুপ। এখানেই আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
বাথরুমের মধ্যে প্রবেশ করে বাথরুমের ঈষদুন্মুক্ত দরজাপথে তীক্ষ্ণ সতর্ক দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকেন ঘরের ভিতরে প্রশান্ত বসাক।
সময় যেন আর কাটতে চায় না। ভারী পাথরের মত যেন সমস্ত অনুভূতির উপরে চেপে বসেছে সময়ের মুহূর্তগুলো। যেন অত্যন্ত শ্লথ ও প্রলম্বিত মুহূর্তগুলি মনে হয়।
তবু এক সময় মিনিটে মিনিটে প্রায় তিন কোয়াটার সময় অতিবাহিত হয়ে যায়।
সুজাতার পা দুটো যেন টনটন করছে।
রেডিয়াম ডায়েলযুক্ত দামী হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে প্রশান্ত বসাক দেখলেন, রাত প্রায় পৌনে একটা। নাঃ! আজ রাতে বোধ হয় এল না।
কিন্তু মিঃ বসাকের চাপা কণ্ঠে উচ্চারিত কথাটা শেষ হল না। ইতিমধ্যে আকাশে বোধ হয় চাঁদ দেখা দিয়েছিল, সামান্য চাঁদের আলো বাগানের দিককার ভোলা জানলাপথে ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করেছিল।
খুট করে একটা যেন অস্পষ্ট শব্দ শোনা গেল। এবং তারপরই প্রশান্ত বসাক দেখলেন কে একজন জানলাপথে মাথা তুলে ঘরের ভিতর উঁকি দিচ্ছে।
এসেছে। অনুমান তাহলে তাঁর মিথ্যা হয়নি।
অস্বাভাবিক একটা উত্তেজনার ঢেউ যেন মুহূর্তে মিঃ বসাকের সমস্ত ইন্দ্রিয় ও অনুভূতির উপর দিয়ে বিদ্যুৎ-তরঙ্গের মতই প্রবাহিত হয়ে যায়।
জানলাপথে ওদিকে ততক্ষণে মাথার সঙ্গে সঙ্গে দেহের ঊর্ধ্বাংশও স্পষ্ট হয়ে ওঠে মিঃ বসাকের চোখের সামনে। জানলাপথেই ছায়ামূর্তি ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল।
ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসছে পায়ে পায়ে শয্যার দিকে। শয্যার একেবারে কাছটিতে দাঁড়াল।
হঠাৎ চমকে উঠলেন মিঃ বসাক।
খোলা জানলায় আর একখানি মুখ দেখা গেল। এবং বিড়ালের মতই নিঃশব্দে দ্বিতীয় ছায়ামূর্তিও ঘরে প্রবেশ করল প্রায় প্রথম ছায়ামূর্তির পিছনে পিছনেই।